‘চোখের বদলে চোখ, গোটা বিশ্বকে অন্ধ করে দেবে’- গান্ধীজি’র উক্তিটির মধ্যে একটি ব্যাপার খুব স্পষ্ট। সহিংসতা কখনওই কোনো কিছুর হাতিয়ার হতে পারে না, বরং গোটা বিশ্বকে ধংস করবার জন্য এটি যথেষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথাই ধরা যাক না, সহিংসতার আঘাতে যেখানে লক্ষ লক্ষ প্রাণ অকালে ঝরে পরেছে। অথচ এই বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব না থাকলে পৃথিবীর ইতিহাসটাই হয়তো ভিন্ন হতে পারতো।
সহিংসতা কিংবা উগ্রবাদ কখনওই কোনো সমাধান নয়। আর এই বিষয়টি যিনি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি ভারতের কিংবদন্তী নেতা এবং অহিংস রাজনীতির প্রবর্তক মহাত্মা গান্ধী। গান্ধীর রাজনৈতিক আদর্শের মূল কথাই ছিল অহিংস সত্যাগ্রহ কর্মপদ্ধতি। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্য আর অহিংসা অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত। সত্যাগ্রহ ও অহিংস আন্দোলনের মতো বিরল কিন্তু এই শক্তিশালী অস্ত্রের দ্বারাই তিনি ব্রিটিশ রাজত্বকে নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন।
গান্ধী যেন অন্ধকারে থাকা মানুষগুলোর কাছে আলোর মশাল নিয়ে এসেছিলেন। এসেছিলেন নতুন করে ভাবাতে। তিনি শুধু মুখেই বলেননি বরং প্রমাণ করেছেন সহিংসতা কিংবা উগ্রবাদ ছাড়াও দাবি আদায় সম্ভব, স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব।
১৯২০ সালের কথা, তখন উপমহাদেশে ইংরেজদের শাসন। ইংরেজদের অত্যাচারে তখন সকলেই অতিষ্ঠ। এমন সময় ব্রিটিশ সরকারের সমস্ত অন্যায় অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে গান্ধীজি ভারতবাসীর প্রতি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ‘আন্দোলন’ শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে যে এক ধরণের সহিংসতার চিত্র ভেসে ওঠে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন কিন্তু মোটেও সেরকম কিছু ছিল না। বরং তিনি ব্রিটিশদের বুঝিয়েছিলেন তাদের সহিংসতার চেয়েও গান্ধীজির অসহিংসতার শক্তি কতখানি বেশি! তিনি ভারতবাসীর প্রতি আহনান জানান সকল বিদেশী পণ্য বর্জন করতে। তাঁর লক্ষ্য ছিল ইংরেজরা যেন উপমহাদেশে ব্যবসা করতে না পারে। অন্যদিকে বিদেশী পণ্য বাদ দিয়ে তিনি নিজেদের উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দেন । যেন স্বনির্ভরতা বাড়ে। তিনি শুধু ভারতবাসীর প্রতি আহবান জানিয়েই ক্ষান্ত হন নি। তিনি নিজেও চরকায় সুতো কেটে পোশাক তৈরি করেছিলেন।
আরেকবার লবণের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করায় গান্ধীজি হাজার হাজার ভারতীয়দের সাথে পায়ে হেঁটে ডান্ডির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ইতিহাস একে Salt March বলা হয়ে থাকে। শুধু মাত্র নিজ হাতে লবণ তৈরির জন্য পায়ে হেঁটে ১২ই মার্চ থেকে ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত হেঁটে এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি পৌছান। এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি প্রায় ২৪১ মাইলের পথ । সে সময় ব্রিটিশরাজ সেই অপমানের বদলা নিতে ৬০,০০০ ভারতীয়কে গ্রেপ্তার করে।
অনেকেই মনে করতে পারেন, গান্ধীজির অহিংস-নীতি এমন কী কঠিন কাজ। এটা তো সকলেই পারে। আসলেই কি সকলের পক্ষে সম্ভব অহিংস হয়ে ওঠা? একটা ঘটনা বলা যাক, একবার সাবারকর নামের এক ডাক্তার গান্ধীর সঙ্গে তার হিংসা-অহিংসা নীতি নিয়ে তর্ক শুরু করলেন। সাবারকর বলেন, ‘গান্ধী, মনে করুন একটা বিরাট বিষধর সাপ আপনার দিকে তেড়ে আসছে। আর আপনার হাতে আছে একগাছা লাঠি। আপনি কী করবেন? মারবেন না মরবেন? গান্ধী উত্তর দেন, ‘লাঠিখানা আমি ছুড়ে ফেলে দেব। পাছে ওকে মারবার প্রলোভন জাগে।’
এই হলো মহাত্মার অহিংসাদর্শন, জীবন সংকটাপন্ন জেনেও যিনি আদর্শে অটল থাকতে পারেন তিনিই তো সত্যিকারের মানুষ।
গান্ধীজী সম্পর্কে আরও জানতে ক্লিক করুন