কথায় বলে না, রক্তের বদলে রক্ত কিংবা জীবনের বদলে জীবন? আক্ষরিক অর্থেই কিন্তু এটি ঘটেছিলো মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের সঙ্গে। একটু খুলেই বলি ঘটনাটা।
সম্রাট বাবরের ছেলে হুমায়ূন তখন বেশ অসুস্থ। কিশোর ছেলের অসুস্থতা দিন দিন বাবাকে মানসিকভাবে কাবু করে ফেলছে। কোন ধরণের চিকিৎসাই ছেলের আরোগ্যলাভে সাহায্য করতে পারছে না। ঠিক সেসময় সম্রাট বাবর তার নিজের জীবনের পরিবর্তে চেয়ে বসলেন তার কিশোর পুত্রের জীবন! একরাতে তিনি পুত্রের শয্যার পাশে চক্রাকারে ঘুরতে লাগলেন, আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ, যদি একজনের প্রাণ নিয়ে আরেকজনের প্রাণ ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়, তাহলে পুত্রের প্রাণের বিনিময়ে আমার নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে আমি প্রস্তুত।’ ‘হুমায়ুন কে সুস্থ করে দাও, আর হমায়ুনের অসুখ আমাকে দাও’-এমন সব প্রার্থনা।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এর কিছুদিন পরেই হুমায়ুন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। আর সম্রাট বাবর ধীরে ধীরে অসুস্থ হতে শুরু করলেন। একসময় দুর্লভ রোগ থেকে যেন সহজেই রোগমুক্তি পেলেন হুমায়ূন, কিন্তু পিতা বাবর? খুব দ্রুত শেষবারের মত অসুস্থ্য হয়ে চোখের পাতা ফেললেন সম্রাট বাবর। দিনটা ২৬ ডিসেম্বর ১৫৩০।
এ যেন এক অবিশ্বাস্য গল্পের পাতা থেকে উঠে আসা কোন কাল্পনিক চরিত্রের কথা। কিন্তু মোগলদের ইতিহাস কি আদৌও কল্পনার চেয়ে কিছু কম? আর আজ আমরা এই অবিশ্বাস্য ও রহস্যাবৃত এক দীর্ঘ সময় ধরে হিন্দুস্থান ও আশেপাশের ক্ষমতা ধরে রাখা মোগলদের শাষণামল নিয়ে কিছু বইয়ের কথা বলবো। যা আপনাদেরকে এমন অবিশ্বাস ও রোমাঞ্চকর ঘটনারই মুখোমুখি করবে না; বরং নিয়ে যাবে হাজার বছর আগের মোগলদের অনন্য এক দুনিয়ায়।
বাদশাহ নামদার (হুমায়ূন আহমেদ)
‘বাদশাহ নামদার’ হুমায়ূন আহমেদের অসামান্য সৃষ্টিগুলোর অন্যতম। উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের পুত্র নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন মির্জাকে নিয়ে, যিনি পিতার দিক থেকে তৈমুরের পঞ্চম অধস্তন এবং মাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খানের পঞ্চদশ পুরুষ। হুমায়ূন আহমেদ বইটির সূচনা করেছেন মোগল বংশের প্রথম সম্রাট বাবরের শাসনামলের সমাপ্তি দিয়ে এবং শেষ করেছেন সম্রাট আকবরের শাসনামলের সূচনা দিয়ে। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, এই বইটিতে মূলত স্থান পেয়েছে বাদশাহ হুমায়ুনের মোগল বংশের রাজ্য শাসন ও শের শাহের নিকট রাজ্য হারানো এবং পরবর্তীতে আবার রাজ্য ফিরে পাওয়ার কাহিনী।

এই বইতে বেশ কিছু অপ্রচলিত তথ্য আমরা দেখতে পাই। আমরা জানতে পারি, কীভাবে সারাজীবন সম্রাট হুমায়ূনের বিশ্বস্ত বৈরাম খাঁ-কে হুমায়ূনপুত্র আকবর ক্ষমতায় এসে সরিয়ে দেয়। এছাড়াও উঠে এসেছে বেশ কিছু চিরকুট এবং কবিতা।
‘দর আইনা গরচে খুন নুমাই বাশদ
পৈবস্তা জ খেশতন জুদাই বাশদ।
খুদ রা ব মিসলে গোর দীদন অজব অস্ত;
ঈ বুল অজবো কারে খুদাই বাশদ।“
“”
যদিও দর্পণে আপন চেহারা দেখা যায়
কিন্তু তা পৃথক থাকে
নিজে নিজেকে অন্যরূপে দেখা
আশ্চর্যের ব্যাপার।
এ হলো আল্লাহর অলৌকিক কাজ।
[হিন্দুস্থানের অধীশ্বর দিল্লীর সম্রাট শের শাহকে পাঠানো রাজ্যহারা হুমায়ূনের কবিতা]
মোগলনামা (মাহমুদুর রহমান)
প্রচলিত ধারনা অনুসারে বাবর তার ছেলে হুমায়ুনের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু মোগলনামা গ্রন্থের লেখক মাহমুদুর রহমান বলছেন, হুমায়ুনের সুস্থ হওয়া এবং তার পরপর বাবুরের মৃত্যু কাকতালীয়। বিষক্রিয়ায় বাবুরের মৃত্যু সম্পর্কে একটি তত্ত্ব দিয়েছেন তিনি মোগলনামা প্রথম খন্ডে। তাহলে পুরনে ঘটনাটি কি ভুল? নাকি এতোদিন ভুল ব্যাখ্যা করা হতো। কোহিনূরের সাথেও নাকি এই ঘটনার যোগসূত্র আছে?

মোগলনামা ইতিহাস বলা হলে অনিবার্য ভাবে চলে আসে যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, মোগল জৌলুশ এবং ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলা অনেক গালগপ্পো। কিন্তু ভারতবর্ষ হতে উত্তরে, শীতপ্রধান এক ছোট রাজ্য ফারগানা থেকে এসে দিল্লীতে যে সাম্রাজ্যের পত্তন করেছিলেন বাবর; সে বংশের ইতিহাস, সে সময়ের ইতিহাস বলতে গেলে প্রয়োজন বিস্তৃতি এবং কালক্রমিক ঘটনাবলির তুলনামূলক বিবরণ, বিশ্লেষণ। এই বইটিতে, মোগল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের উত্থান থেকে শুরু করে আওরঙ্গজেবের মৃত্যু পর্যন্ত ভারতবর্ষের মোঘল শাষনের কালক্রমিক বিবরণ দেওয়া হয়েছে, উপযুক্ত তথ্য এবং বিশ্লেষণের সাথে।
মুঘল ভারত (স্যার যদুনাথ সরকার)
এই গ্রন্থের লেখক যদুনাথ সরকার, যিনি কিনা স্বনামধন্য বাঙালি ইতিহাসবিদ। তিনিই প্রথম মীর্জা নাথান রচিত বাহারিস্তান-ই-গায়বী’র পাণ্ডুলিপি ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত জাতীয় গ্রন্থাগারে খুঁজে পান এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন জার্নালে বাংলা ও ইংরেজিতে প্রবন্ধ লিখে বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণায় যদুনাথ সরকার পথিকৃৎ বা পথ প্রদর্শক ছিলেন। এই কারণে দেশবাসী তাকে আচার্য হিসাবে বরণ করেছিলেন।

এরকম একজন ইতিহাসবিদের লেখা মোগলদের ইতিকথা, মোঘলদেরকে ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে আপনাকে বাধ্য করবে।
মোগল হেরেমের অন্তরালে (আনিস সিদ্দিকী)
আমাদের বর্তমান সমাজের তরুণদের মধ্যে ইতিহাসপাঠ বিমুখতা বড় বেশি নজরে পড়েছে। অথচ এটি সর্ববাদীসম্মত যে, কোনো জাতি যদি বড় হতে চায় তবে তাকে ইতিহাসের পাঠ অবশ্যই নিতে হবে। অতীত ইতিহাস আমাদের সামনে শুধু অতীত ঐশ্বর্যের মণিমালাই তুলে ধরে না বরঞ্চ কোথায় আমাদের গলদ ছিল, ভ্রান্তি ও বিভ্রম ছিল তাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এটাকেই বলা হয় ‘ইতিহাসের শিক্ষা’।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঠকদের জানা থাকলেও পরিপূর্ণ চিত্রটি সম্ভবত জানা ছিল না। এ চিত্রের সঙ্গে পাঠক সম্পূর্ণ একমত হবেন তাও ভরসা করে বলতে পারি না। ইতিহাস শুধু ইতিহাসই। কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাস ইতিহাসের পৃথিবীতে অবস্থান করে কল্পনার রং মিশিয়ে এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করে। মনে হয় এদের বুঝি চিনি-তবে এত কাছের মানুষ হিসেবে বুঝি চিনতাম না।
এ শর্ট হিস্টোরি অব আওরঙ্গজেব
১৯৩০ সালে প্রথম প্রকাশিত স্যার যদুনাথ সরকারের ‘এ শর্ট হিস্টোরি অব আওরঙ্গজেব’ আজও সারা পৃথিবীতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এটা তাঁর পাঁচ খন্ডের সুবিশাল কর্মের সংক্ষেপিত সংস্করণ। ছাত্র এবং অন্যান্য আগ্রহী পাঠকের সুবিধার্থে এই সংক্ষেপের কাজটি করেছেন স্যার যদুনাথ স্বয়ং। সংক্ষেপিতকরণে তিনি এমনই মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন যে মূল গ্রন্থের কোনরওকম অঙ্গহানি হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ইতিহাসের কৌতূহলী পাঠকদের জন্যে এই গ্রন্থটি অমূল্য বলে বিবেচিত।
মোগল সম্রাট শাহজাহান (সৈয়দ আবিদ রিজভি)
শাহজাহান তাঁর রাজত্বকালে তাঁর পূর্বসূরিদের ন্যায় বেশ কিছু প্রাসাদ ও অট্টালিকা নির্মাণ করিয়েছিলেন। তিনি মোগল স্থাপত্যের মহান পৃষ্ঠপোষকদের অন্যতম ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সৌধ হলো তাজমহল যা তার প্রিয়তমা পত্নী মুমতাজ মহলের স্মৃতিরক্ষার জন্য নির্মাণ করিয়েছিলেন। কথিত হয় যে, এই মহান সৌধের নকশা তার স্বর্গীয় ভাবনার ফসল যা তিনি স্বপ্নে লাভ করেছিলেন। তার গঠনশৈলী ও পরিকল্পনা তখনও পর্যন্ত ছিল মানব-কল্পনার অতীত। এর বিনির্মাণে তিনি পৃথিবীর সকল দেশের স্থাপত্য-কলা-বিশারদদের নিজের দেশে আহবান জানিয়েছিলেন। এই মহান সৌধ নির্মাণ সম্পন্ন করতে ২০ হাজার শ্রমিকের বাইশ বছর সময় লেগেছিল। এটি নির্মিত হয় শ্বের-মর্মর দিয়ে।…. শাহেনশাহ শাহজাহানের মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেব তাঁকে তাজমহলে মুমতাজের পাশেই দাফন করিয়েছিলেন।

এদিকে শাহজাহান ছিলেন পান-দোষ মুক্ত, উন্নত চরিত্র, সাবলীল দৈহিক ও মানসিক শক্তির অধিকারী, ধার্মিক এবং দয়ালু। শুভ্র শান্ত হৃদয়, উন্নত মননশীলতার অধিকারী এক সুযোগ্য রাজপুত্র। মোগল রাজদরবারে তার যোগ্যতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েই গিয়েছিল। তাঁর সৎ-ভাইদের সঙ্গে তাঁর পিতার সম্রাজ্যের উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্বে তিনি নিজেকে সযত্নে সরিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু রাজদরবারে সবার অলক্ষে যেটা ঘটে যাচ্ছিল তা হলো সাম্রাজ্যের ঘটনাপঞ্জির লেখকদের দ্বারা দীর্ঘকাল ধরে সম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী রূপে তিনিই পরিগণিত হয়ে চলেছিলেন। ১৬০৭ ঈসায়ী সনে খুররমকে হিসারফিরোজার জারগিরি অনুমোদন করে জাহাঙ্গীর প্রকারান্তরে তার শাহি পদমর্যাদা ও পরম্পরাগত উত্তরাধিকার স্বীকার করে নেন।
1 thought on “চলুন, একটু মোগল সাম্রাজ্য থেকে ঘুরে আসি!”
??? অসাধারণ