ডাক্তারি তাঁর পেশা হলেও ডাক্তার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে পারেননি তেমন। তবে লেখক হিসেবে তাঁর অসামান্য খ্যাতির সর্ববৃহৎ প্রমাণ তাঁর-ই সৃষ্ট অমর চরিত্র — শার্লক হোমস। জি ! আজ গল্প হবে শার্লক হোমসের স্রষ্টা — স্যার আর্থার কোনান ডয়েলকে নিয়ে। শার্লক হোমস এর নাম শোনেনি এমন কাউকে কি আদৌ খুঁজে পাওয়া সম্ভব?! তবে শার্লক হোমস নামটি বিশ্বব্যাপী যতজনের পরিচিত, কোনান ডয়েল নামটি সম্ভবত তার অর্ধেকেরও পরিচিত নয়। সৃষ্টি যে কখনো কখনো স্রষ্টার চেয়েও উপরে উঠে যেতে পারে, এ যেন তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তবে ডয়েলের আরও একটি বিখ্যাত চরিত্র রয়েছে — প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। এছাড়াও তিনি লিখেছেন আরও অনেক কিছুই। সেসবের মধ্যে রয়েছে সায়েন্স ফিকশন, নাটক, রোম্যান্স, কবিতা, ঐতিহাসিক উপন্যাস, স্মৃতিকথা আর কিছু নন-ফিকশন রচনা।
আর্থার কোনান ডয়েলকে নিয়ে আবার কিছু অদ্ভুত গল্পও প্রচলিত আছে। এমনই কিছু অজানা, অদ্ভুতুড়ে, মজার গল্পই থাকছে আজকের রচনায়।

নিজে গোয়েন্দাকাহিনির লেখক হলে কী হবে, আর্থার কোনান ডয়েল কিন্তু অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস করতেন ! মানে যাকে আমরা জাদুবিদ্যা বলি। ১৯১৭ সালে, ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ড শহরের কটিংলিতে দুই বোন পাঁচটি ছবি তুলেছিল। সেই ছবিগুলোতে কিছু ছোট ছোট পরীদের দেখা যায়। ওদের বাবা ছিলেন শখের ফটোগ্রাফার। ওদের বাবাই জানান, বড় বোন এলসি যেহেতু ছবির কিছু কিছু কারিকুরি শিখেছিল, তাই সম্ভবত এলসি-ই ছবিগুলোতে কারিকুরি করে পরী বানিয়েছিল। কিন্তু কোনান ডয়েল কিন্তু ছবিগুলোর সত্যতা মেনে নিয়েছিলেন। এমনকি সেই ছবিগুলো নিয়ে তিনি রীতিমতো একটি বই-ও লিখেছিলেন।
শুধু তাই নয়, সে সময় হ্যারি হুডিনি নামের এক জাদুকর বেশ নাম করেছিল। বিশেষ করে, হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বা অন্য কোনোভাবে তাকে বন্দি করে রাখার পর একা একাই বের হয়ে আসার খেলা দেখানো তিনি-ই শুরু করেন। একবার তো জীবন্ত কবর দিয়ে দেওয়ার পর সেখান থেকেও বেরিয়ে আসেন তিনি। সে যাই হোক, জাদুকররা তো মূলত কৌশলে জাদু দেখায়; এ তো আর সত্যি কিছু নয় ! শেষজীবনে সে কথা স্বীকারও করেছিলেন হ্যারি ‘হ্যান্ডকাফ’ হুডিনি। এ কথাও কিন্তু কোনান ডয়েল বিশ্বাস করতেন না ! তার ধারণা ছিল, জাদুকররা সত্যিই জাদু জানে। এমনকি, তিনি জাদু জানেন না, কৌশলের মাধ্যমে জাদু দেখান — এ কথা স্বীকার করার পর হ্যারি হুডিনির সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বেরও ইতি ঘটান কোনান ডয়েল।
যে শার্লক হোমস চরিত্রটির জন্য ডয়েল জগদ্বিখ্যাত, সেই চরিত্রটির পেছনে ছিলেন একজন সত্যিকার মানুষ, নাম প্রফেসর জোসেফ বেল। তিনি কোনান ডয়েলের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক শিক্ষক। জোসেফ বেলের চরিত্র শার্লক হোমস-এ এতটাই পরিষ্কার যে, একবার তো কোনান ডয়েলকে একজন জিজ্ঞেসই করে বসলেন, “শার্লক কি আমার বন্ধু জো?”
বোঝাই যাচ্ছে, বন্ধুটি জোসেফ বেলকে ‘জো’ বলেই ডাকতেন।
কোনান ডয়েল সবচেয়ে বেশি যে চরিত্রটি নিয়ে লিখেছেন তা হল — শার্লক হোমস। শার্লক হোমসকে নিয়ে লেখা তাঁর গল্পের সংখ্যা ৫৪টি আর উপন্যাস সংখ্যা ৪টি। মজার ব্যাপার হল, এই শার্লক হোমসকে নিয়ে লিখতে লিখতেও একসময় অধৈর্য হয়ে গিয়েছিলেন কোনান। ১৮৯১ সালে মাকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমি হোমসকে খুন করানোর চিন্তা করছি……সে আমার মাথা থেকে অন্যান্য জিনিসগুলোকে বের করে দিচ্ছে।”

এই চিন্তা থেকেই ‘দ্য ফাইনাল প্রবলেম’ গল্পে তিনি শার্লক হোমসকে খুন করালেন। আর তারপর, তাঁর মায়ের কথা মতোই, সব পাঠক শার্লককে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাতে শুরু করল। পাঠকের চাপে শেষমেশ ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য এম্পটি হাউজ’ গল্পে অবিশ্বাস্যভাবে ফিরিয়ে আনা হলো শার্লককে।
কোনান ডয়েল যে ডাক্তার ছিলেন এবং ডাক্তার হিসেবে খুব সফলও ছিলেন না, সে কথা আগেই বলেছি। এটি অবশ্য তাঁর জন্য শাপে বর-ই হয়েছিল। কারণ, রোগী না থাকায় তিনি লেখার সময় বেশি পেতেন। শুধু তাই না ! ডাক্তারিতে পসার নেই দেখে, কোনান ডয়েল পরে চোখের উপর আরও পড়ালেখা করলেন। মানে তিনি চোখের বিশেষায়িত ডাক্তার হলেন।
কিন্তু লাভ হল কী ! লন্ডনে তাঁর চোখের ডাক্তারির চেম্বারে একটি রোগীও কখনও ঢোকেনি !
আর্থার কোনান ডয়েলকে নিয়ে আরেকটি মজার ঘটনা আছে। তিনি ব্রিটেনের রানির কাছ থেকে নাইটহুড পেয়েছিলেন। নাইটহুড হল একটি সম্মানসূচক উপাধি। এই উপাধি পেলে তাঁর নামের আগে ‘স্যার’ বলা যায়। নাইটহুড পেয়েছিলেন বলেই আমরা তাঁকে ‘স্যার আর্থার কোনান ডয়েল’ বলি। মজার বিষয় হল, সকলের ধারণা তিনি নাইটহুড পেয়েছিলেন শার্লক হোমসের জন্য। আসলে তিনি কিন্তু শার্লক হোমসের জন্য নাইটহুড পান নি। তিনি নাইটহুড পেয়েছিলেন বোয়ার যুদ্ধের উপর লেখা তাঁর নন-ফিকশন রচনাগুলোর জন্য।
কোনান ডয়েল আবার একজন রাজনৈতিক চরিত্রও ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে তিনি রীতিমতো রাজনীতির আঙিনায় নেমে পড়েছিলেন। এমনকি ব্রিটেনে নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন। তা-ও একবার নয়, বরং দু’বার। আর হেরেছিলেনও দু’বার-ই! তবে প্রতিবারই তিনি মোটামুটি ভালো ভোট-ই পেয়েছিলেন।
ডয়েলের ছিল চমৎকার এক প্রতিভা, যার কথা হয়তো অনেকেরই অজানা — বড্ড ভালো ক্রিকেট খেলতেন তিনি। জন্মগতভাবে তো তিনি ব্রিটিশ। আর ব্রিটিশরা ক্রিকেট পছন্দ করবে না, তা কি হয় ! বেশ ভালোই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অনেক ভালো ভালো ম্যাচ খেলেছেন কোনান ডয়েল। তাঁর ব্যাটিং মূলত ছিল শক্তিনির্ভর। আজকের এই টি-২০ জামানায় যেমন পাঠান, ব্রেথওয়েট, বাটলাররা ব্যাট করেন, কোনান ডয়েল ব্যাটিং করতেন খানিকটা ওই কায়দায়। তাঁর সঙ্গে আবার বলও করতেন। সেটা অবশ্য জোরে নয়। তাতেই যদি কোনো কোনো ম্যাচে ৭ উইকেট নিয়ে থাকেন, তাহলে আর জোরে বল করে হবেটা কী !
এবার বলি আর্থার কোনান ডয়েলের সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়টি। শার্লকের স্রষ্টা নিজেও শার্লক হোমসের মতো গোয়েন্দাগিরি করেছিলেন দু’বার। উন্মোচন করেছিলেন দুটি সত্যিকার রহস্য। বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন দু’জনকে। প্রথম রহস্যটিতে ভুক্তভোগী ভদ্রলোকের নাম ছিল জর্জ এডালজি। আর দ্বিতীয়টিতে ভুক্তভোগী ছিলেন অস্কার স্ল্যাটার।
জর্জ এডালজির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল পশু নির্যাতনের। কিন্তু ডয়েল দেখালেন যে, এডালজির বিরুদ্ধে যেসব পশু নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে, সেসব পশুদের নির্যাতন করার মতো শারীরিক শক্তিও এডালজির নেই। তাছাড়া, তার বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোও সঠিক নয়।
জর্জ এডালজির ভাগ্য ভালো ছিল যে কোনান ডয়েলের বদৌলতে তিনি বেঁচে যান। কিন্তু অস্কার স্ল্যাটারের ভাগ্য ততটা ভালো ছিল না। এক মহিলাকে খুন করার অভিযোগ ছিল স্ল্যাটারের বিরুদ্ধে। কোনান ডয়েল এখানেও দেখালেন, প্রমাণগুলো সবই ভুল। এমনকি খুনের সময় স্ল্যাটার অন্যত্র ছিলেন। কিন্তু ততদিনে রায় হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত বিনা দোষে সাড়ে ১৮ বছর কারাভোগের পর ছাড়া পান স্ল্যাটার।
আরও পড়ুন- জাহানারা ইমাম: জননী সাহসিকা যাঁর উপাধি
স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের বইগুলো দেখুন