অন্নপূর্ণা উত্তরিলা গাঙ্গিনীর তীরে,
পার কর বলিয়া ডাকিল পাটুনীরে…
প্রণমিয়া পাটুনী কহিছে জোড় হাতে,
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।
-ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর
পৃথিবীর প্রায় সব বাবা-মায়েরাই যেন সন্তানের প্রতি এই চিন্তা নিয়েই থাকে- যত কিছু ঘটুক, অন্তত আমার সন্তান যেন দুধে-ভাতে থাকতে পারে। এজন্য আমরা অনেকে বলি, মা-বাবার ঘরটা হয়তো শিশুর জন্য সাজানো বাগান। রেনেসা ব্যান্ডের সেই গানের মত, ‘আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই’। কিন্তু আসলেই কি এই পৃথিবীতে আমরা কোমলমতি শিশুদের জন্য সাজানো বাগান এনে দিতে পেরেছি। সুকান্তের সেই বাসযোগ্য পৃথিবী? আপনার কোমলমতি সন্তানকে মানুষ করতে হলে স্বপ্ন থাকতে হবে অনেক বড়। হ্যাঁ, আপনার সন্তান হবে স্বপ্নের চেয়ে বড়।
পৃথিবীতে যখন কোন শিশু জন্ম নেয় তখন কিন্তু সে জানে না পৃথিবীটা কেমন। সে জানে না কোন পরিবেশে জন্ম হয়েছে তার। সময়ের সাথে সাথে সে বুঝতে শেখে তার আশেপাশের পরিবেশ, সেই পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টাটাও শিখে ফেলে। তবে একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ কিংবা সমাজ একটি শিশুকে সুন্দর মানুষে পরিণত করতে অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবেশের পাশাপাশি শিশুটির বাবা-মায়ের আচার-আচরণ, শিক্ষা, শৃঙ্খলা তাকে চরিত্রবাণ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। বাবা-মায়ের প্রতিটা দোষগুণ পরবর্তীতে সন্তানের মধ্যে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। যদিও আমাদের অনেকের ধারণা, এসব দোষগুণ নিয়েই সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু এগুলো সম্পূর্ণভাবে ভুল ধারণা। জন্ম নেয়ার পর পর বাবা-মায়ের সুশিক্ষা শিশুকে মানসিকভাবে উন্নত করতে সাহায্য করে।

শিশুর বয়স অনুযায়ী তার অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতা এবং তার সামাজিকভাবে বিকাশের সঠিক পরিবেশ থাকতে হয়। কেমন করে বন্ধুদের সঙ্গে একটি বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়, যাতে আমার বন্ধু আমাকে বিশ্বাস করে এবং আমিও বিশ্বাস করি আমার বন্ধুকে, কেমন করে সেরকম সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় শিশুর বাবা-মা এবং শিক্ষকের সঙ্গেও। এরকম সব শিক্ষা শিশুদের মাঝে দায়িত্বশীলতার বীজ বুনে দেয়। যদি তার মাঝে বিশ্বাসের বীজ বোপন করতে চাই তবে শিশুকে একটি নিরাপদ পরিবেশ দেয়া প্রয়োজন। শিশুকে উৎসাহের মাঝে বড় হতে দিতে হবে, তাদের আনন্দের সঙ্গী হতে হবে, তাদের দুঃখকে ভাগ করে নিতে জানতে হবে, তাদের অনুভূতি প্রকাশের সঠিক পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। মোটকথা, শিশুদের ভবিষ্যতের অগ্রযাত্রায় বাবা-মা এবং শিক্ষক যারা আছেন তাদের দায়িত্ব বিশাল।
আবার পারিবারিক কলহের চাপে অনেক শিশুর স্বাভাবিক জীবনই অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এ ধরনের ঘটনায় শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেসব শিশু মা-বাবার মনোমালিন্য দেখতে দেখতে বড় হয়, তারা হতাশ, অসামাজিক ও সহিংস হয়ে ওঠে। নানা অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকে। তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। ফলে মনঃসংযোগের ঘাটতিও দেখা দেয়। মানসিক রোগ ও ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা ঘটতে পারে। ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১২’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা গিয়েছিলো, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ১৮.৩৫ শতাংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত। সংখ্যাটি কিন্তু মোটেও কম নয়। অন্যদিকে এমন ঘটনা আবার মেয়েশিশুর তুলনায় ছেলেশিশুর মধ্যে বেশি। ১৭.৪৭ শতাংশ মেয়েশিশুর পাশাপাশি ১৯.২১ শতাংশ ছেলেশিশু মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকে। যেটি আরও ভয়ংকর দিকে ইঙ্গিত দেয়। গবেষকরা ধারণা করেন, শিশুদের ওপর মানসিক আঘাতের প্রভাব অনেকক্ষেত্রেই দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষতিকর। যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মানসিক আঘাত শিশুর পরবর্তী জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে, আবেগজাত সমস্যায় আক্রান্ত করে।
বাবা-মায়েদের কলহ সন্তানকে প্রভাবিত করে
পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক কেমন এটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ তাদের দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা কেমন সেটাও। তাদের একজন আরেকজনের সাথে কী ধরনের আচরণ করছেন সেটা শিশুর বেড়ে ওঠার উপর বড় রকমের প্রভাব ফেলে। বলতে গেলে শিশুর সবকিছুই এতে প্রভাবিত হয়। যেমন তার মানসিক স্বাস্থ্য কী রকম হবে, পড়ালেখায় সে কেমন করবে, এমনকি ভবিষ্যতে এই শিশু যেসব সম্পর্কে জড়াবে সেগুলো কেমন হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই ঝগড়াবিবাদ নানা রকমের হয়ে থাকে। কোন কোন বিতর্কের হয়তো প্রভাবই পড়ে না, এমনকি শিশুর ভবিষ্যতের জন্যে সেটা হয়তো ভালোও হতে পারে, কিন্তু পিতা মাতা যখন একে অপরের প্রতি ক্রুদ্ধ আচরণ করেন, করেন চিৎকার চেঁচামেচি, অথবা তারা একে অপরের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন, তখনই হয়তো কিছু একটা সমস্যা দেখা দিতে পারে। একইভাবে, এরকম পরিস্থিতিতে শিশু কিভাবে বেড়ে উঠবে বা সাড়া দেবে সেটা তার জিনগত গঠন বা জেনেটিক্সের উপরেও নির্ভর করে। তবে এটা ঠিক যে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর পিতামাতার আচরণ বড় রকমের প্রভাব ফেলে এবং সেখান থেকে তার ভেতরে দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা ও মানসিক সমস্যারও সৃষ্টি হতে পারে।
সন্তানকে বাড়তে দিন নিজের মত
কোমলমতি শিশুদের মানসিক অবস্থা কিন্তু বড়দের মত নয়। মানসিকভাবে তারা বেশ সংবেদনশীল। তাই বাবা-মায়ের অযাচিত হস্তক্ষেপ সবসময় ভালো ফলাফল বয়ে নিয়ে আসে না; বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।
শিশুদের মানসিক বিকাশে স্বাধীনচেতা মনভোবা খুব জরুরী। শিশুরা যখন কৈশোরে পদার্পন করে তখন তাদের মধ্যে অনেক ধরণের মানসিক পরিবর্তন দেখা যায়। যেহেতু তখন তারা আত্মপরিচয়ে বড় হতে চায় তাই তাদের সঙ্গে বাবা-মায়ের মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এমতাবস্থায় বাবা-মায়ের কৌশলী হওয়া জরুরী। সঙ্গে সঙ্গে ছেলে-মেয়ের ব্যাপারে অযাচিত হস্তক্ষেপ না করে; বরং তাদেরকে সৃজনশীল কর্মকান্ডের মধ্যে রেখে এক ধরণের সুস্থ্য পরিবেশে বড় করার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
১. বেড়াতে যাওয়া
বড় হতে হতে একটি শিশু আশপাশের নানা কিছু থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। ভ্রমণ শিশুদের মনে আগ্রহ জাগায়, নতুনকে জানতে, আবিষ্কার করতে। দৈনন্দিন জীবনে পরিবর্তনও আনে। এখন অনেক মা-বাবা দিনে কর্মস্থলে ব্যস্ত থাকেন, বাড়ি ফিরেও মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা টিভি দেখে সময় কাটান। তাই বাচ্চাদের সত্যিকারভাবে সঙ্গ দেওয়ার আদর্শ উপায় হতে পারে ভ্রমণ।
২. সৃজনশীল খেলনা
শিশুর খেলনা হতে হবে আবিষ্কারধর্মী, নাটকীয় ও সৃজনশীল। বয়সভেদে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ উপযোগী খেলনা নির্বাচন করতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। ঘরে ও বাইরে দুই জায়গায়ই খেলা যায়—এমন খেলনা শিশুর মানসিক বিকাশে বেশি সহায়ক। শিশুকে এমন ধরনের খেলনা দিতে হবে, যা তার বুদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করে। আঁকাআঁকির বিভিন্ন সামগ্রী থেকে শুরু করে বিজ্ঞান ও গবেষণার প্রতি আগ্রহীদের সেসম্পর্কিত বিভিন্ন খেলনা দেয়া যেতে পারে।
৩. বই পড়া
বই শিশু মনের সুপ্ত ভাবনার বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে। একসময় মা-খালা-দাদির মুখ থেকে ঠাকুমার ঝুলির গল্প শুনে সময় কাটতো শিশুদের। এখন এর ব্যতিক্রম ঘটছে। আগেকার সেসব গল্প এখন শিশুরা শুনতে পারে না। শিশু বয়স থেকেই তাই শিক্ষামূলক বইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। গল্পের বই পড়ার মাধ্যমে শিশুর মানসিক বিকাশ প্রসারিত হয় এবং মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা বাড়ে। এর ফলে শিশুরা জটিল শব্দ ও বাক্য সহজে বুঝতে পারে। এতে তার পড়ার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়, সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় শিশুর বুদ্ধিমত্তা।
৪. সুস্থ পারিপার্শ্বিক পরিবেশ
একটি শিশু যখন বড় হয়, তখন চারদিকের পরিবেশ তাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে এবং এর প্রতিফলন ঘটে তার ব্যক্তিত্বে। শিশুর সামগ্রিক বিকাশের সঙ্গে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা নিবিড়ভাবে জড়িত। আজকের শিশু ভবিষ্যতের নাগরিক। তাই তার সুন্দর ও নির্ভয় শৈশব নিশ্চিত করার দায়িত্ব মা–বাবাসহ পরিবারের সব সদস্যের।
৫. বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো
শুধুমাত্র পরিবার কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গৎবাঁধা শিক্ষাই নয়; বরং প্রতিবেশী ও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাও আপনার সন্তানের সুস্থ্য ও স্বাভাবিক মানসিক বিকাশে সহায়তা করে। সব শিশুরা একভাবে বেড়ে ওঠে না। কেউ কেউ মানসিকভাবে অন্তর্মুখী সমস্যায় ভুগলে তাদের জন্য বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণা ছাড়াও বন্ধুদের সঙ্গে একান্ত সময় কাটানো জরুরী।
শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য মা-বাবাকেই নিতে হবে সবচেয়ে বড় উদ্যোগ। মা-বাবা ছাড়া শিশুর চারপাশের পরিচিত মানুষরাই তার বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রধান কারণ মা-বাবা সন্তানের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটান, তাদের নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেন, সর্বদা তাদের মঙ্গল কামনা করেন এবং অন্যদের চেয়ে ভালোভাবে তাদের বুঝতে পারেন। তাই সন্তানরাও মা-বাবার ওপর ভরসা ও নির্ভর করে। শিশুরা অনেক সময় তাদের বন্ধুবান্ধব ও ভাই-বোনের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখে। কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলে, অন্য শিশুর কাছ থেকে শেখার চেয়ে বড়দের সহযোগীতার মাধ্যমে কোনো কিছু শিখলে শিশুদের বিকাশ বেশি হয়। বর্তমান যুগে পরিস্থিতি অনেক সময় এমন হয়ে যায় যে মা-বাবা দুজনকেই জীবিকার জন্য কাজে বের হতে হয়। ফলে শিশুকে দেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় তাঁদের থাকে না। অনেকেই নির্ভর করেন কাজের মানুষের ওপর। এ জন্য যতটুকু সময়ই তাঁরা শিশুর কাছে থাকতে পারেন, সে সময়টাকে মানসম্মত করে তুলতে পারলে সেটা শিশুর বিকাশে অনেক অবদান রাখতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, শিশুর মৌলিক চাহিদাগুলো অপূর্ণ থাকার জন্য কিন্তু তার মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষুণ্ন হয়। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বাসগৃহ ও বিদ্যালয়ের পরিবেশ মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অনুকূল হওয়া প্রয়োজন।
শিশু-কিশোরদের উপযোগী বইগুলো দেখতে ক্লিক করুন