জ্যাঁ পিঁয়াজে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৬ সালে, সুইজারল্যাণ্ডে। তার বাবা ছিলেন নিউচাতাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক। পিঁয়াজে জীবনের সাফল্যের জন্য তার বুদ্ধিদীপ্ত ও উৎসাহব্যাঞ্জক পারিবারিক পরিবেশের কথা বারবার বলেছেন। বড় হওয়ার পর তার অধিকাংশ সময় বাবার সাথে পৃথিবীর নানা বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে কেটেছে।
জন্ম থেকেই পিঁয়াজে একজন প্রাকৃতিক পর্যবেক্ষক। এই পর্যবেক্ষণের অসাধারণ ক্ষমতাকে তিনি কাজে লাগালেন প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের কাজে। এগারো বছর বয়সে তার প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় একটি স্থানীয় বিজ্ঞান পত্রিকায়, ’জার্নাল অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি অব নিউচাতাল’-এ। এরপরে নিউচাতালের মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির তত্ত্বাবধায়ক বিশিষ্ট প্রাণিবিদ পল গডেটের সাথে পিঁয়াজের পরিচয় হয়।
গডেট পিঁয়াজেকে শিখালেন কীভাবে গ্রামের পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক জীবন পর্যবেক্ষণ করতে হয়। এর ফলে স্থানীয় জলাশয় ও লেকের প্রতি তার আগ্রহ বেড়ে যায় । গবেষণার স্বার্থেই তিনি ঐসব জলাশয়ে থাকা বিভিন্ন প্রাণীর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন।
কৈশোরে লেখাপড়ার পাশাপাশি পিঁয়াজে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের কাজও করতে থাকেন। এসময় তার বেশিরভাগ সময় কাটে একধরণের ছত্রাক পর্যবেক্ষণ করে। পিঁয়াজের জীবনে তার বাবা এবং গডেট ছাড়াও আরো একজনের প্রভাব পড়েছিল। তিনি হলেন পিঁয়াজের ধর্মপিতা স্যামুয়েল কারনেট।
তাছাড়া ফরাসি দার্শনিক হেনরি বার্গসনের সাথেও তাঁর পরিচয় হয়। তিনি বার্গসনের জীববিজ্ঞান এবং অন্যান্য ভাব দ্বারা প্রভাবিত হন। বার্গসনের বই পড়েই পিঁয়াজে জীববিদ্যার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই আগ্রহ জীববিদ্যার প্রতি তার প্যাশনকে বাড়িয়ে দেয় এবং তিনি বিজ্ঞান ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে একত্রিত করে একটি নতুন দর্শন সৃষ্টির অনুপ্রেরণা লাভ করেন।
পিঁয়াজে ১৯১৪ সালে নিউচাতাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শুরু করেন। এখানে একজন শিক্ষক ছিলেন, তার নাম রেমণ্ড। ইনি দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব উভয় বিষয়েই সমান পারদর্শী ছিলেন। ধর্ম এবং জীববিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পিঁয়াজে তার শিক্ষাজীবনে ডক্টরাল থিসিস করেন এককোষী জীব-ছত্রাকের উপর ।পিঁয়াজের লেখা প্রথম দুটি বইতে দর্শনের প্রতি তার আগ্রহ ফুটে ওঠে। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি নিজেই এই লেখাগুলোকে ‘বয়ঃসন্ধিকালীন শিশুতোষ চিন্তা’ বলে বাতিল করে দিয়েছেন।
তার উপর কান্টের প্রভাব ছিলো বলে পিঁয়াজে নিজেই দাবী করেছেন। তিনি প্রচুর পড়তেন। যা কিছু জোগাড় করতে পেরেছিলেন- কান্ট, স্পেন্সার, কোঁতে, দুর্খেইম, উইলিয়াম জেমস, জেনেট, ইয়ুং এবং ফ্রয়েডের সব রচনাই তিনি পড়ে ফেলেন। ১৯২৯ সালের শেষের দিকে যখন তিনি একজন মনোবিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন তখনো পিঁয়াজে ছত্রাক এবং ধর্মীয় ধারণা নিয়ে লেখালেখিতে ব্যস্ত ছিলেন।
পিঁয়াজের মতে, শিশুরা কিভাবে বস্তু ও সংখ্যার পার্থক্য ধরতে পারে এবং কিভাবে কোন ঘটনার পেছনের যুক্তি বুঝতে পারে, তা জানা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিশুদের যুক্তি বুঝতে পারার ধারা বিশ্লেষণ করতে পারলে বড়দের চিন্তার প্রক্রিয়াকেও বোঝা সহজ হবে।১৯১৯ সালে পিঁয়াজে জুরিখ থেকে প্যারিসে যান এবং সেখানে তিনি বার্গসনের লেকচার শুনেন। তাছাড়া সেখানে তিনি মার্কিন মনোবিজ্ঞানের পূর্বসূরি জেমস মার্ক ও বল্ডউইনের সাথে পরিচিত হন।
তিনি বল্ডউইনের কাছ থেকে দুটি ধারণা গ্রহণ করেন
– অনুকরণের গুরুত্ব (imitation)
– বিপরীতমুখী ক্রিয়া (reversible operation)
এ সময়ে প্যারিসে তিনি থিয়োডোর সাইমনের সাথে পরিচিত হন, যিনি ছিলেন আলফ্রেড বিনের সহকর্মী। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা নিরুপণের জন্য বিনে-সিমন টেস্ট তখন বেশ জনপ্রিয় (যা পরবর্তীতে Stanford–Binet Intelligence Scales নামে পরিচিত)। পিঁয়াজে আলফ্রেড বিনের ল্যাবরেটরীতে পোস্ট ডক্টরাল গবেষক হিসেবে কাজ করেন এবং তখন তিনি বিনের বুদ্ধি অভীক্ষার সাথেও পরিচিত হন।
পিয়াজে মনে করতেন যে, মানব জাতির বিবর্তনের ইতিহাস গর্ভাবস্থায় শিশুর বিকাশের মাধ্যমে পুনরাবৃত্ত হয়। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ অতীতে যেভাবে বিবর্তিত হয়েছিলো, তার জীবন চক্রের প্রথম স্তর থেকে সেই ঘটনাই আবার ঘটতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- শিশুদের হাঁটতে শেখার পরে দেওয়ালে আঁকতে চাওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতার সাথে আদিম মানবের গুহাচিত্র আঁকার মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
সম্ভবত এই ধারণার বশবর্তী হয়েই পিঁয়াজে শিশুদের চিন্তার বিবর্তনের ধারণটি প্রবর্তন করেন। তাঁর মতে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের চিন্তার প্রক্রিয়া একই হয়ে থাকে। শিশুদের বর্তমানে আমরা যেভাবে চিন্তা করতে দেখি, অতীতেও তারা একইভাবে চিন্তা করত ।
শুধু তাই নয় সারা বিশ্বের শিশুরা একইভাবে চিন্তা করে। তিনি দৃঢ়ভাবে মনে করতেন যে, প্যারিস থেকে পানামা পর্যন্ত সকল শিশু একইভাবে বিকাশ লাভ করে। ভৌগলিক, পুষ্টিগত ও লালন-পালন প্রক্রিয়ার ভিন্নতার কারণে তাদের বুদ্ধি আলাদা হলেও, মানসিক পরিপক্বতা অর্জনের ক্ষেত্রে সবার নীতিই একই।
পিঁয়াজের গবেষণাগুলোর সাথে তার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবন জড়িয়ে আছে। ১৯২৫, ১৯২৭, ১৯৩২ সাল- এই তিনটি বছরে পিঁয়াজে পরপর তিনটি সন্তান লাভ করেন। সন্তান জন্মাবার পর তিনি শিশু বিকাশের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন। শিশুরা যা দেখে শিখে এবং যা অনুমান করে শিখে- এই দুই ধরণের শেখা থেকে যে আচরণ করে, পিঁয়াজে তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এ পর্যায়ের রচনাগুলোর মূল কথা ছিল শিশুর জ্ঞান বিকাশ সম্পর্কিত তত্ত্ব। এতে শিশুর প্রাথমিক জীবনের প্রতিপালনের সাথে জৈবিক ও পরিবেশগত অভিজ্ঞতার মধ্যে সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। নিজের শিশুদের ছাড়া তিনি আরও গবেষণা করেছিলেন স্কুল বয়সী শিশু ও কিশোরদের উপর।
পিঁয়াজের বক্তব্যে একটি আপাত বিরোধিতা বিদ্যমান। একদিকে মনে হয় জ্ঞানীয় বিকাশের মূল সুত্র হলো জৈবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু অপরদিকে মনে হয়, চারপাশের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও উপকরণকে কাজে লাগিয়ে শিশু নতুন জ্ঞান লাভ করে, যেখানে অন্য কোন ব্যক্তির অংশগ্রহণ বা সহযোগিতার তেমন কোন প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে অভিভাবক ও শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত সীমিত। শিশু কোন নতুন জ্ঞান তার স্বাভাবিক বিকাশ ধারার মাধ্যমে অর্জন করবে। এর জন্য চাপাচাপি করাটা স্বভাব বিরুদ্ধ।
শিশুকে কিভাবে শিক্ষা দিতে হবে এ ব্যাপারে পিঁয়াজে অসংখ্য বক্তৃতা ও পরামর্শ দিয়ে গেছেন। পিঁয়াজের তত্ত্বে স্ববিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও তার গবেষণা প্রেক্ষিতে তাঁকে শিক্ষাবিজ্ঞানের একজন দিকপাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তিনি তার জীবনের বহু বছর Genetic Epistemology-র কাজের জন্য উৎসর্গ করেন। বিকাশের নীতি কিভাবে শিশুদের প্রভাবিত করে, তিনি শুধু তা জেনেই ক্ষান্ত হননি, বরং গণিত, জীববিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা লাভের ক্ষেত্রে এ সকল নীতি কীভাবে শিশুদের প্রভাবিত করে তাও জানার চেষ্টা করেন। পিঁয়াজের জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথে তার মতবাদগুলো বিভিন্ন সম্মেলনে আলোচিত হতে থাকে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি শিশু বিকাশের নীতি, শিক্ষণের নীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন।
comments (0)