একটা সময় ছিলো কোন জাতি বা দেশ সম্পর্কে জানতে হলে আগে সবাই তাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতো। যাদের ইতিহাস সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ তাদের ব্যাপারে সবাই ওয়াকিবহল হতো। কিন্তু এখন ইতিহাসের প্রতি আমাদের জানার আগ্রহ নিতান্তই কম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এখন এদেশের নাটক-সিনেমায়ও অনেকখানি বিস্মৃত।
এমন একটা সময় এসে দাঁড়িয়েছে, ইতিহাস হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার একটি বিষয় মাত্র। কিন্তু এখনও আমরা যদি তথাকথিত উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই তবে দেখবো, সবাই তাদের শেকড়কে আকড়ে ধরেছে পোক্তভাবে। শুধু তাই নয়, ইউরোপিনরা যেমন নিজেদের হাজার বছরের ইতিহাস সংরক্ষণ করছে, ঠিক তেমনি অপরদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা দেশগুলো তাদের প্রযুক্তি কাজে লাগাচ্ছে ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য। তার মাঝামাঝি অবস্থায় দাঁড়িয়ে ইতিহাস নিয়ে যতটা বেশি ভাবনার কথা ছিলো তা কি আদৌ আমরা করছি? রাজনৈতিক বিভিন্ন জটিলতার বেড়াজালে ইতিহাসকে ফেলে হাত গুটিয়ে নেয়া আমাদের সত্ত্বাটাকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে, ‘আমাদের কি ইতিহাস জানার দায় নেই??’
বাঙালী জাতির ইতিহাস অনেক বেশি সমৃদ্ধ। আমাদের এখানে যত বড় হস্তিবাহিনী ছিলো তা দেখে স্বয়ং আলেকজান্ডার ফিরে গিয়েছিলেন এই ভেবে যে, এদের সাথে যুদ্ধ করে জেতা সম্ভব নয়। অথচ তখন পাশ্চাত্য সভ্যতার নাম-গন্ধও সেভাবে পাওয়া যায় না। কিন্তু আমরা কি আমাদের ইতিহাস ভুলতে বসেছি? অত আগের সময়ে না গিয়ে আমরা যদি মাত্র অর্ধ শতাব্দী আগেও যাই, দেখতে পাবো গণমানুষের অভ্যুত্থানের এক রক্ত গরম করা ইতিহাস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ গঠন হয়েছে বলে মনে হলেও বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবে তার স্বপ্ন বোনা হয়েছিলো অনেক আগেই। ১৯৪৭ সালে এক ভূ-খন্ড থেকেই ভারতের দেশভাগের পর এটি আরো বেশি হাতছানি দিতে থাকে। কিন্তু দেশভাগের মর্মস্পর্শীতা হারিয়ে যায় তৎকালীন বিভিন্ন সংকটের আড়ালে। মূলত দেশভাগের সময় মানুষের আবেগের এ ফোঁড়–ও ফোঁড় করার ইতিহাস নিয়ে জানতে আমরা আগ্রহী নই। কিন্তু ইতিহাস কাউকে ছেড়ে কথা বলে না।
দেশভাগ নিয়ে কথা উঠলে সাহিত্যের বড় একটা পরিবর্তন চোখে পড়ে। কথা আছে, সাহিত্য সমাজের দর্পন। আয়নায় যেমন ছবিটা বেশ স্পষ্ট ভেসে ওঠে তেমনি সাহিত্যেও সমাজের চিত্র ভেসে ওঠে। হয়তো অন্য নামে, অন্য কোনোভাবে। দেশভাগের দুঃখ সবচেয়ে তীব্রভাবে যাদের লেখায় উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে অনন্য একজন ব্যক্তি ছিলেন সা’দত হোসেন মান্টো। তাঁর লেখা মাত্র ২২টা ছোটগল্পের সংকলন এবং ১টি উপন্যাসে বার বার উঠে এসেছে দেশভাগ পরবর্তী সময়ে এই স্থানের কথা। দেখানো হয়েছে কত সব জীবনের সংকট। এখানে মান্টোর লেখা একটি অনু গল্পের উদাহরণ দেয়া যাক। গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৫২ সালে ‘সিয়াহ হাশিয়ে’ নামের একটি গল্পগ্রন্থ থেকে। লাহোরের ‘মাকতাবাতুল জাদীদ’ নামের একটি প্রকাশনী থেকে। গল্পটি কিছুটা এরকম-
ভোর ছয়টার সময় পেট্রলপাম্পের কাছে ঠেলাগাড়িতে বরফ ফেরিওয়ালার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। সাতটা পর্যন্ত লাশ পড়ে রইল রাস্তায়। ঠেলা থেকে বরফ গলে গলে পানি হয়ে পড়তে থাকল।
সোয়া সাতটা বাজলে পর পুলিশ লাশ উঠিয়ে নিয়ে গেল। বরফ আর রক্ত সেই রাস্তায়ই পড়ে থাকল।
পাশ দিয়ে একটা টাঙ্গা চলে গেল। তাতে বসা ছোট একটা বাচ্চা রাস্তায় জমে থাকা উজ্জ্বল থকথকে রক্তের দিকে তাকাল। ওর জিভে জল এসে পড়ল। সে তার মায়ের হাত টেনে আঙুল দিয়ে সে দিকে দেখিয়ে বলল, ‘দেখ মা, জেলি!’
এইটুকুন গল্পেই উঠে আসে কত শত মানুষের জীবনের দ্বন্দ্ব। এই গল্পটি সংকলন করা হয়েছে ‘সিয়াহ হাশিয়ে’ নামক গল্পগ্রন্থ থেকে। যেটি কালো সীমানা নামে অনুবাদ করেছেন জাভেদ হুসেন। গল্প ছাড়া কবিতার মধ্যেও ফুটে উঠেছে দেশভাগের পরবর্তী সময় তথা ১৯৪৭ সালের পরের মানবিক বিভিন্ন আবেদনের চিত্র। যদি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাই ধরা হয়, আমরা তার কবিতার বই ‘রাত্রের রঁদেভু’ তে দেখি বিখ্যাত সেই কবিতা যেটি দুই বাংলার মানুষকে উপলব্ধি করিয়েছে দেশভাগের বাস্তবতা।
“সাঁকোটির কথা মনে আছে, আনোয়ার?
এত কিছু গেল, সাঁকোটি এখনো আছে
এপার ওপার স্মৃতিময় একাকার
সাঁকোটা দুলছে, এই আমি তোর কাছে”

এছাড়াও জয় গোস্বামীর লেখা ‘সূর্য-পোড়া ছাই’ বইতে দেখতে পাই আমরা অনন্য কবিতা-
“জল থেকে ডাঙ্গায় উঠে ওরা
পালিয়ে চলেছে আজীবন
এক যুগ থেকে অন্য যুগে
উড়ে আসে ক্ষেপনাস্ত্র, তীর
ছেলে বৌ মেয়ে বুড়ো জননী ও শিশু কোলাহল
দাউদাউ উদ্বাস্তু শিবির”

সত্যি বলতে ফিকশন সাহিত্যে দেশভাগ কিংবা সেসময়ের ইতিহাসের প্রতিফলন ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ইতিহাসের বই বলতে আমরা যা বুঝি সেরকম বইও রয়েছে অহরহ। ইতিহাস জানার যেমন দায় রয়েছে, তেমনি ইতিহাস জানানোর দায় থেকেই মানব জীবনের সেসময়কার সুখ-দুঃখের মাঝেও বাস্তব চিত্র নিয়ে লিখে গেছেন সেসময়কার লেখকরা।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরবর্তী সময়কে যদি আমরা একদিকে রাখি, তবে বাংলাদেশের ইতিহাসকে মোটাদাগে দুভাগে ভাগ করা যায়। এক. মুক্তিযুদ্ধ বা তার প্রেক্ষাপট। এবং দুই. মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন রাজনৈতিক সংকটের সময়কাল। আমরা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ইতিহাস নিয়ে সংক্ষেপে এই লেখার শেষে আলোচনা করবো। এখন আসা যাক মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে। সত্যি বলতে দ্বিধা নেই, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে মানুষ। কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত অসংখ্যবার টানাপোড়েন ঘটেছে দেশীয় পটভূমিতে। সেই রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে এখনো রয়েছে ধোঁয়াশা। কিন্তু সেই সময়টাকে ভালোভাবে বুঝতে পড়া যেতে পারে বেশ কিছু বই। আগেই বলে রাখছি, সেসময়কার রাজনৈতিক সংকট ধোঁয়াশায় থাকার কারণে প্রায় প্রত্যেকটি বইকে ঘিরেই রয়েছে বহু বিতর্ক। আমরা বিতর্ককে এক দিকে রেখে শুধুমাত্র ইতিহাস জানার প্রত্যয়ে বেশ কিছু বইয়ের সাথে পরিচিত হতে পারি।
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতার প্রথম দশ বছর নিয়ে দুর্দান্ত একটি বই লিখেছিলেন মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীরবিক্রম। ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য’ নামক বইটিতে তিনি তুলে এনেছেন ১৯৭১ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত স্বাধীনতার এক দশকে ঘটে চলা ইতিহাসের বিভিন্ন দিকমাত্রার কথা। যেহেতু সেসময় সেনাবাহিনীর বেশ কিছু অভ্যুত্থান ঘটেছিলো, তাই অন্য ঐতিহাসিকদের থেকে সেনা সদস্যদের লেখা বইয়ের প্রতি পাঠকদের আগ্রহ বেশি দেখা যায়। এছাড়াও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবঃ) এম এ হামিদ পিএসসি রচিত আরেকটি দুর্দান্ত বই ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’। তবে সেনা অভ্যুত্থান এবং সেসময়কার হত্যাকান্ড নিয়ে আলোচনা হলে উঠে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং মেজর জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের কথা। মূলত বাংলাদেশের বর্তমান দুটো প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা হওয়ায় এই দুটো হত্যাকান্ড সেসময়কার ইতিহাসের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে মোঃ নুরুল আনোয়ারের লেখা ‘বঙ্গবন্ধু, জিয়া, মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড জতুগৃহ একটিই’ বইটি এই হত্যাকান্ডের বিভিন্ন দিকমাত্রা নিয়ে আলোচনা করে।
এবার ফিরে আসি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। আসলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের আবেগের একটি অধ্যায়, তেমনি এটি এত বেশি ঘটনাবহুল যে একভাবে দেখলে ইতিহাস ঠিকঠাকভাবে বোঝা সম্ভব নয়। তাছাড়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হলেও এর প্রভাব এরপরেও বহুবছর রয়েছে বিভিন্ন ভাবে। আমর যদি আনিসুল হকের লেখা ‘মা’ বইটির কথাই চিন্তা করি; তবে দেখবো, শহীদ আজাদ মায়ের কাছে ভাত খেতে চেয়েছিলেন কিন্তু মা পরদিন এসে দেখেন আজাদকে শহীদ করা হয়েছে। তখন মা আরো ১৪ বছর বেঁচেছিলেন অথচ একবারও ভাত খাননি। মুক্তিযুদ্ধের পরও এই ত্যাগের ইতিহাস পৃথিবীর বুকে আমাদের মাথা উঁচু করে বাঁচবার অনেক বেশি সাহস যুগিয়েছে।


আরও দুটি বই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আত্মজীবনীমূলক বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। আর অন্যটি হলো- বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের কন্যা শারমিন আহমেদের লেখা ‘নেতা ও পিতা’। বইটি পেপারব্যাকে কম মূল্যে পাওয়া যায়। তবে মুক্তিযুদ্ধ ঠিক যেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে হয়েছে তার উপর ড. কামাল হোসেনের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল’ বইটি বেশ প্রাসঙ্গিক।

তবে আগেই বলেছি আমাদের ইতিহাস অনেক বেশি সমৃদ্ধ। মোঘলদের সময়ের পরেও ব্রিটিশদের উপনিবেশায়ন আমাদেরকে দাস হিসেবে দুইশো বছর আটকে রাখলেও আমরা ফিরে এসেছি স্বমহিমায়। এজন্যই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন-
আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!
সুতরাং ইতিহাস জানার দায় থেকে, অন্তত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ‘র ইতিহাস সঠিকভাবে জানার দায় থেকে হলেও, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত ইতিহাসকে সঠিকভাবে গ্রহণ করা, যাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম শেকড় আঁকড়ে ধরে থাকে; সেই সাথে পৃথিবীও জানতে পারে আমাদের সকল দুর্দশা পেছনে ফেলে মাথা উঁচু করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার গল্প।