বাংলা সাহিত্যের প্রথম সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞান কে লিখেছিলেন তা নিয়ে রয়েছে বিশাল বিতর্ক। তবে সেটা যেই লিখুক না কেন, এত বছর পরে সায়েন্স ফিকশনের আবেদন এতটুকুও কমেনি। ছোটবেলায় যখন সায়েন্স ফিকশনের নাম শুনতাম, তখন মনের ভেতর একটা আধো বাস্তব দৃশ্য ভেসে উঠতো। যার মধ্যে প্রযুক্তির বিশাল মারপ্যাঁচ। কিন্তু বাংলা ভাষায় সায়েন্স ফিকশনের এই অগ্রযাত্রা বিশ্ব সাহিত্যের নিরিখে কতটুকু এগোতে পেরেছে? চলুন আজকে জেনে আসা যাক বাংলা সায়েন্স ফিকশনে আমাদের যাত্রা।
আগেই বলেছি, বাংলা সাহিত্যের প্রথম সায়েন্স ফিকশন কে লিখেছিলেন তা নিয়ে আছে মহা বিতর্ক। জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৯৬ সালে লেখেন ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’। বলা হয় এটিই বাংলা ভাষার প্রথম সায়েন্স ফিকশন। তবে তারও প্রায় চৌদ্দ বছর আগে ১৮৮২ সালে ‘রহস্য’ নামে একটি গল্প লিখেছিলেন হেমল দত্ত। কিন্তু একটি কল্পবিজ্ঞান বা সায়েন্স ফিকশনের যেসব উপাদান থাকা দরকার সেসবের উপস্থিতি না থাকায় হেমল দত্তের গল্পকে অনেকেই প্রথম সায়েন্স ফিকশন মানতে নারাজ। সাধারণ সায়েন্স ফিকশনে বিজ্ঞানের নতুন আবিস্কার কিংবা তাক লাগানোর মত কিছু ব্যাপার থাকে। হেমল দত্তের ‘রহস্য’ গল্পে সেভাবে এগুলোর উপস্থিতি না থাকায় এটাকে অনেকে সায়েন্স ফিকশন হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান না। তবে শুধু হেমল দত্ত কিংবা জগদীশ চন্দ্র বসুই নয়; বরং অনেকের ধারণা বাংলায় সায়েন্স ফিকশন লেখা হয়েছিলো আরো আগে। অবিভক্ত বাংলায় প্রথম উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক জগদানন্দ রায়। তাঁর লেখা ‘শুক্র ভ্রমণ’ বইটির কাহিনি ছিল পৃথিবীর বাইরের এক গ্রহে যাত্রার আখ্যান। তার এ বইটি প্রকাশ হয় এইচ. ওয়েলসের ‘ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস’ প্রকাশেরও প্রায় ১০ বছর আগে, ১৮৭৯ সালে। গল্পটা অবশ্য লেখা হয়েছিল তারও ১১ বছর আগে, ১৮৫৭ সালে।

তবে মজার ব্যাপার হলো, সায়েন্স ফিকশনের বাংলা প্রতিশব্দ ‘কল্পবিজ্ঞান’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিলো আরো অনেক পরে। ১৯৬৩ সালে ‘আশ্চর্য’ পত্রিকার সম্পাদক অদ্রীশ বর্ধনই মাথা খাটিয়ে এই বাংলা প্রতিশব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন বলে জানা যায়। তবে বাংলায় প্রথম নারী সায়েন্স ফিকশন লেখিকা হলেন বেগম রোকেয়া। মাদ্রাজ ভিত্তিক ইংরেজি ম্যাগাজিন ‘ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিন’- এ ১৯০৫ সাল থেকে রোকেয়ার ধারাবাহিক ‘Sultana’s Dream’ (সুলতানার স্বপ্ন) প্রকাশিত হয়েছিলো। অবশ্য সেটা ইংরেজিতে লেখা হতো। তার কয়েক বছর পর ১৯০৮ সালে এটি বই আকারে প্রকাশ হয়। সেসময়কার অনেকেই সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞান নিয়ে লেখায় আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র বেশ কয়েকবার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে হাত দিয়েছেন। বেশ কিছু সময় পর ‘মেঘদূতের মর্ত্যে আগমণ’ নামে আরেকটি সায়েন্স ফিকশন লিখেছিলেন হেমেন্দ্র কুমার রায়।

তবে যে যাই বলুক, বাংলা ভাষায় সায়েন্স ফিকশন নিয়ে খেলে গেছেন সুকুমার রায়। তিনি বরাবরের মতই এই জায়গাতেও ছিলেন একদমই আলাদা। মেশিনপত্রের ঝনঝনানি কিংবা প্রযুক্তির কঠিন থিওরি কোনটাই তাকে সেরকম ভাবে আগ্রহী করেনি। তিনি স্বমহিমায় লিখে গেছেন তার চিরায়ত রসাত্মোবোধ দিয়ে। হেঁসেরাম হুঁসিয়ারের ডায়রি বইতে সুকুমার রায় বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে এনেছেন দারুন এক বৈচিত্র্যতা। সেখানে আমরা দেখতে পাই ‘চিল্লানোসরোস’ নামের অদ্ভুত এক প্রানীকে। যেই প্রানীর বৈশিষ্ট্য হলো বিকট আকারে চিৎকার করা। আর ভোদরের মত দেখতে গোমরা মুখের এক প্রানীকেও আমরা দেখি। যার নাম ‘গোমরাথেরিয়াম’। এটিকে শুধুমাত্র সাধারণ রসাত্মবোধ হিসেবে বর্ণনা করলে সুকুমার রায়ের সাথে অবিচার করা হবে। আদতে এটি ছিলো বাংলা ভাষার সায়েন্স ফিকশনের এক নতুন দিক মাত্রা।

তার উত্তরসুরী হয়েছেন তারই পুত্র সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কর্মের মধ্যে সৃষ্টি করে রেখে গেছেন ‘প্রফেসর শঙ্কু’র মত চরিত্রকে। ১৯৬১ সালে প্রথম প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে সন্দেশ পত্রিকার বাইরেও প্রফেসর শঙ্কুর বেশ কয়েকটি বই বেরিয়েছিলো। যদিও প্রফেসর শঙ্কু তৈরী করতে গিয়ে সত্যজিৎ তাঁর বাবা সুকুমার রায়কে মোটেও অনুসরন করেননি। এখানে বরং বিভিন্ন অদ্ভুত মেশিনের উল্লেখ বেশি দেখা যায়। তবে বাংলা ভাষার সায়েন্স ফিকশন জগতে বেশ অনেকদিন টানা নেতৃত্ব দিয়েছে সত্যজিতের এই সৃষ্টি। সত্যজিৎ রায় এরপর লিখেছিলেন মি. অ্যাং। কথিত আছে, মিস্টার অ্যাং নিয়ে একটি গল্পের পান্ডুলিপি তিনি পাঠিয়েছিলেন স্টিভেন স্পিলবার্গের কাছে। স্পিলবার্গ সেই সত্যজিতের মি. অ্যাং চরিত্রের আদলেই তৈরি করেছিলেন কালজয়ী সায়েন্স ফিকশন চলচিত্র ‘ইটি’।

এবার তবে বাংলাদেশ হবার পরে সায়েন্স ফিকশনের অবস্থা নিয়ে কথা বলা যাক। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সায়েন্স ফিকশন লিখেছিলেন কাজী আব্দুল হালিম। গল্পের নাম ছিলো ‘মহাশূন্যের কান্না’। তবে এই সাই ফাই নিয়েও কিছুটা বিতর্ক আছে। অনেক সমালোচকদের মতে এই গল্পতে আদর্শ সায়েন্স ফিকশনের অনেক উপাদানই অনুপস্থিত ছিলো। সে হিসেবে তার পরেই প্রকাশিত সায়েন্স ফিকশন লেখেন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’। অনেকের কাছে এই বইটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলাদেশী বিজ্ঞান কথাসাহিত্য উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয়।
সায়েন্স ফিকশনের এরকম ‘প্রথম’ বিষয়ক বিতর্কের পর যারপরনাই প্রশ্ন আসে সায়েন্স ফিকশন বলতে আসলে আমরা কী বুঝি। বেশিরভাগ পাঠকদের কাছেই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। তবে সায়েন্স ফিকশনের স্রষ্টা খ্যাত আইজাক আসিমভের মতে, ‘সায়েন্স ফিকশন বৈজ্ঞানিক যুক্তির বাইরের কিছু নয়। যুক্তি ও প্রমাণীত সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই সায়েন্স ফিকশন লিখতে হবে। তবে সৃষ্টিশীল তথা নতুনত্ব না থাকলে তাকে যথার্থ সায়েন্স ফিকশন বলা যাবে না। সে হিসেবে কিন্তু এই ‘প্রথম হবার কৃতিত্ব’ নিয়ে ঘষামাজা করাটাই এক ধরণের অবান্তর প্রসঙ্গ।

প্রকৃত অর্থে সায়েন্স ফিকশনের অন্যতম প্রধান কিছু উপাদান হচ্ছে সময় ভ্রমন, বহিঃজাগতিক প্রাণ প্রভৃতি, উন্নততর কোন প্রযুক্তির সন্ধ্যান, ভবিষ্যতের পৃথিবীর সম্ভাব্য চিত্র ইত্যাদি। সাহিত্যের এই শাখাটিকে বলা হয় ‘লিটারেচার অফ আইডিয়াস’। তবে বাংলার সায়েন্স ফিকশনের বেশ অনেক আগেই বিশ্বসাহিত্যে প্রথম সায়েন্স ফিকশন গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত পেয়েছিলো ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন‘ নামের বইটি। লিখেছিলেন মেরি শেলি। বইটি প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালে। এরপর জুল ভার্ন এ ধারার লেখালেখিকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যান।

আবার বরং বাংলাদেশের সায়েন্স ফিকশনে ফেরা যাক। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু থেকে বেশ অনেকদিন সায়েন্স ফিকশনের রাজত্ব করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর লেখা ‘দ্বিতীয় মানব’ কিংবা ‘ফিহা সমীকরণ’ অনেক পাঠককেই বাংলার মৌলিক সায়েন্স ফিকশনের আসল স্বাদ অনুভব করার সুযোগ করে দিয়েছিলো। হুমায়ূন আহমেদের সাই ফাই লেখাগুলো এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচলিত সাই ফাই থেকে বেশ আলাদা। তিনি সায়েন্স ফিকশনেও তার চিরায়ত রসবোধ দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রযুক্তি কিংবা ভীনগ্রহের ব্যাপারেও আনতেন মানবিক আবেদন। হাসি কান্নার এরকম অদ্ভুত মিলনশৈলি উপস্থিত থাকার কারণে হুমায়ূন আহমেদের সায়েন্স ফিকশন বইগুলো এত বছর পর এখনো বেশ পাঠকপ্রিয়। তার লেখা ‘অনন্ত নক্ষত্র বীথি’ বহু পাঠকের মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত বই ছিলো। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে সরল ভাষায় এমন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন বহুবার। ‘ওমেগা পয়েন্ট’ নামে তার অন্য বইটির কথাও অনস্বীকার্য।

ঠিক তার পরপরই সায়েন্স ফিকশনের খ্যাতির ছটায় নাম লেখান মুহম্মদ জাফর ইকবাল। কপোট্রনিক ভালোবাসা নামে তিনি একটি গল্প লেখেন তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। গল্পটি প্রকাশিত হবার পরপরই অভিযোগ ওঠে এটি একটি বিদেশী গল্প থেকে নেয়া। তার জবাবে মুহম্মদ জাফর ইকবাল আরো বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখেন। পরবর্তীতে ‘কপোট্রনিক সুখ দুঃখ’ নামে তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয়। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম বইটির বেশ প্রশংসা করেছিলেন। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজেও তাঁর লেখা ‘ত্রাতুলের জগত’ বইটি পড়ে অদ্ভুত আনন্দ পেয়েছিলাম।

তবে স্বাধীনতার এত বছর পর সাহিত্যের শাখা প্রশাখা অনেকদিকে ছড়িয়ে পড়লেও এখনও বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশনের আবেদন একটুও কমেনি। অমর একুশে গ্রন্থমেলা এলেই বিশেষ করে শিশু-কিশোর বয়সী পাঠকদের মধ্যে নতুন সায়েন্স ফিকশন কেনার তুমুল আগ্রহ দেখা যায়। তারই ধারাবাহিকতায় সমসাময়িক বেশ কিছু লেখক দুর্দান্ত সব সায়েন্স ফিকশন উপহার দিয়ে চলেছেন। তেমনই একজন আসিফ মেহদী। ২০১৫ সালে তিনি লেখেন ‘ফ্রিয়ন’ নামের একটি সায়েন্স ফিকশন। তার পরে ধারাবাহিক ভাবে প্রতি বছর তিনি লিখেছেন কোন না কোন সায়েন্স ফিকশন। তার লেখা ‘হিগস প্রলয়’ কিংবা ‘হ্যালু-জিন’ নামের সাই ফাই বইগুলো সমসাময়িক সময়ে পাঠক নন্দিত হয়েছে। এছাড়াও এই সময়ের আরেকজন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক হলেন ধ্রুব নীল। ‘মায়াদ্বীপ ২৩৯০’ বইটি তার লেখা একটি সায়েন্স ফিকশন। এছাড়া কম বয়সী পাঠকদের আনন্দ নিয়ে পড়ার উপযোগী করে তুলতে বেশ কিছু ইলাস্ট্রেশন সহ ‘স্বপ্নচক্র’ বইটি তার লেখা একটি দারুন সায়েন্স ফিকশন।

তবে সায়েন্স ফিকশনের বাইরে আরেকটি জিনিসের সাথে এখানে পরিচয় করিয়ে দেবার লোভ সামলাতে পারছি না। সেটি হলো অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স। বাংলাদেশের প্রথম সায়েন্স কিট। ক্লাসে বিভিন্ন সময় বিজ্ঞানের অনেক ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা জানতে পারে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সেগুলোর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে হলে বিজ্ঞানের কোন বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে হয়। আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় সেভাবে হাতে হাতে বিজ্ঞানের গবেষনার সুযোগ নেই। তাছাড়া শিশু-কিশোর বয়সী ছেলে-মেয়েরা বৈজ্ঞানিক এসব জিনিসপাতি কোথায়ই বা পাবে? এসব কিছুর সমাধান নিয়ে এসেছে অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য ও শিক্ষা বিষয়ক গবেষক সাওরি ইমাইজুমি এই বিজ্ঞান বাক্স দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি পৃথিবীর অনেক দেশের সায়েন্স কিট দেখেছি। কিন্তু এরকমটা কোথাও দেখিনি।‘
বেস্টসেলার সব সায়েন্স ফিকশন বই পেতে ক্লিক করুন!
সত্যি বলতে বিভিন্ন বয়সী বিশেষ করে শিশু কিশোর বয়সী পাঠকদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সায়েন্স ফিকশন টনিকের মত কাজ করে। তাই এই বয়সী পাঠকদেরই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে বেশি আগ্রহী হতে দেখা যায়। ফিকশন মানেই তো এক অদেখা ভূবনের হাতছানি। সেখানে বিজ্ঞানের স্পর্শ পেলে দুর্দান্ত এক জগতের দুয়ার খুলে যায় পাঠকদের সামনে। আর তাই এত বছর পরেও সাহিত্যের ডাল-পালা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেলেও মোটেও কমেনি সায়েন্স ফিকশনের আবেদন। যতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন হবে, ঠিক ততদিন অন্য ভাষার মত বাংলা ভাষার সায়েন্স ফিকশন টিকে থাকবে স্বগৌরবে।