নিজের দেশের ইতিহাস তো নিজের পরিচয়ই প্রকাশ করে। তাই বলা চলে নিজেকে জানতে হলে, জানতে হবে নিজ দেশের ইতিহাসকে। দুঃখের ব্যাপার হলো, বাহ্যিকভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক চর্চা করি বলে মনে হলেও আদতে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান আমাদের মধ্যে সেভাবে দেখা যায় না। আর ইতিহাসকে ধরতে হলে একমাত্র মাধ্যম হলো বই। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চর্চা করতে হলে জানতে হবে ইতিহাসের সত্যতা এবং বেছে নিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের উপর রচিত বইগুলোর মধ্যে দুর্দান্ত কিছু বই। আজ আমরা সংক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বইগুলো থেকে বেছে বেছে এমন কিছু ফিকশন আর নন ফিকশন বই নিয়ে কথা বলবো, যা হয়তোবা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের জানাকে আরো সমৃদ্ধ করবে।

আত্মজীবনী বা স্মৃতিমূলক বেশ অনেক বই লেখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের উপর। সেসময় সম্মুখ সমরে অংশ নেয়া অথবা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরা নিজের চোখের দেখা সেসব স্মৃতির বর্ণনা দিয়ে লিখে রেখেছেন জীবন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামকে। আমরা সেই সকল সম্মুখ সমরে অংশ নেয়া যোদ্ধাদের প্রতি মাথা নত করি এবং যাদের লেখা আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গভীরভাবে জানবার সুযোগ করে দিয়েছে তাদেরকে সম্মান জানাই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিমূলক বইয়ের কথা ভাবলেই প্রথমে যেটি মাথায় আসে সেটি হলো ‘একাত্তরের দিনগুলি’। লিখেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ১৯৭১ সালের নয়টি মাসের প্রত্যেকটি দিন কীরকম ছিলো তার যেন এক ছোঁয়া পাই এই বইটিতে। তবে যিনি একাত্তরের এসব দিনগুলো নোটবুকে টুকে রাখলেন তাঁর তখনকার অবস্থা কেমন ছিলো? যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে আগস্ট মাসে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীরা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় তাঁর স্বামী এবং পুত্রদেরকে। কিছুদিন তাদেরকে ধরে প্রচন্ড নির্যাতন করা হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফেরেন তারা। বেশ কয়েকদিন পর নির্যাতন শেষে ফিরে আসেন স্বামী শরিফ ইমাম এবং তাঁর দ্বিতীয় পুত্র জামী। কিন্তু অন্য পুত্র রুমি ফিরে আসেনি তাদের সঙ্গে। এই রুমি আর কোনদিন ফেরেনি। যুদ্ধের শেষের দিকে জাহানারা ইমামের স্বামী শরিফ ইমামের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। এই নিদারুন জীবনকে টেনে নিয়ে জাহানারা ইমাম লিখেছেন একাত্তরের দিনগুলি। এই বই যেন আক্ষরিক অর্থেই একাত্তরের দিনগুলোর স্বাক্ষী।

এছাড়াও সম্মুখ সমরে অংশ নেয়া একজন ব্যক্তির লেখা বই ‘লক্ষ প্রানের বিনিময়ে’। লিখেছেন রফিকুল ইসলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করে। তিনি ১নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেছিলেন। রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তমের লেখা লক্ষ প্রানের বিনিময়ে বইটি বাংলায় প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। তবে ইংরেজিতে এটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৭৪ সালে A Tale of Millions নামে। এই বইটির আগে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে বিশ্লেষন করে কিছু বই বের হলেও রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের লেখা বইটিকেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

স্মৃতিকথামূলক আরেকটি বই হলো ‘আমার একাত্তর’। লিখেছেন প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি প্রবাসী সরকার-গঠিত প্ল্যানিং সেলের সদস্য ছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিশেষ চরিত্র, তাঁর বেশিরভাগ ভাষণের লেখক ছিলেন স্বয়ং অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
এছাড়াও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, রাষ্ট্রের এত গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পাওয়া আনিসুজ্জামানের বয়স তখন ছিলো মাত্র ৩৪ বছর। আর তাই এতসব রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক উপাদানের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতি মিলে অদ্ভুত সুন্দর একটি বই তৈরি হয়েছে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের হাতে।

তবে যদি মুক্তিযুদ্ধের আগের প্রেক্ষাপট একটু পেছন থেকে জানতে হয় তবে একটি আদর্শ বই হলো আবুল মনসুর আহমেদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইটি। বইটি শুরু হয়েছে ব্রিটিশ ভারতের শাষণের সময় থেকে। আবুল মনসুর আহমেদ ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন অর্ধ শতাব্দীর মত। ব্রিটিশদেরকে এই জায়গা থেকে চলে যাওয়া থেকে শুরু করে পরবর্তীতে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র হবার আগ পর্যন্ত উপর পর্যায়ের রাজনৈতিক খুঁটিনাটি এই বইতে বিস্তারিত ভাবে দেখানো হয়েছে। বইটির কলেবর বেশ বড়। সাড়ে ছয়শো পৃষ্ঠার বেশি বইটি বাংলাদেশ তো বটেই; অখন্ড ভারতের ইতিহাসের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ ছাড়াও আবুল মনসুর আহমেদ বেশ কিছু বই লিখেছেন, যা এই ভূখন্ডের বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে। ব্যক্তিগতভাবে আবুল মনসুর আহমেদ একজন গল্পকার হওয়ায় তার নন ফিকশন বইগুলোও পাঠ করে বেশ আনন্দ পাওয়া যায়।

তবে ব্রিটিশ শাষণ বা অখন্ড ভারতের ইতিহাস জানতে এত পেছনে না গিয়ে ঠিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগ মুহুর্তের প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র হবার ইতিহাস নিয়ে আলোকপাত করা যাক। সেসময় যিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্র হবার পেছনে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটের ইতিহাসের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর লেখা আরেকটি বই ‘আমার দেখা নয়াচীন’ মুলত ভ্রমন বিষয়ক স্মৃতি গ্রন্থ। কিন্তু সেখানে তৎকালীন রাজনৈতিক উপাদান ফুটে উঠেছে যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে স্পষ্ট করতে সাহায্য করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাড়া সেসময় স্বাধীনতার পেছনে সম্পূর্ণ ভাবে সক্রিয় থাকা আরেকজন হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। যাকে বঙ্গ তাজ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তাঁর ঘটনাবহুল জীবন বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও পরবর্তী সময় নিয়ে লিখেছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা শারমিন আহমদ। সে হিসেবে ‘নেতা ও পিতা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বই বটে।

এবার তবে ফিকশন বইগুলোর দিকে তাকানো যাক। মুক্তিযুদ্ধের মত সংবেদনশীল ইতিহাস নিয়ে নন ফিকশন বইগুলোই অধিকাংশ সময়ে বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যেখানে নন ফিকশন বইগুলো এক হিসেবে আক্ষরিক তথ্যই দিয়ে থাকে। কিন্তু গল্প কিংবা উপন্যাসে অতিরঞ্জিত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবুও স্বাধীনতা যুদ্ধের মত একটি সংবেদনশীল ইতিহাস নিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য ফিকশন বই। যেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই উপন্যাস। গল্পের বাইরেও রয়েছে কবিতা কিংবা ছড়ার বই। অনলাইন বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ায় ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইয়ের তালিকা’ নামে একটি নিবন্ধ যুক্ত করেছে। সেখানে গল্প/উপন্যাস, ইতিহাস, অঞ্চলভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, গবেষণা, স্মৃতিচারণ ইত্যাদি সহ আরো এগারোটি ভাগে প্রায় দুইশো পঞ্চাশটির বেশি বইয়ের বিস্তারিত তালিকা দেয়া হয়েছে। তবে এর বাইরেও পাঠকপ্রিয় বেশ কিছু মুক্তিযুদ্ধকে আশ্রয় করে লেখা উপন্যাস কিংবা গল্পের বই রয়েছে।

পাঠকনন্দিত একটি বই হলো ‘জাহান্নম হইতে বিদায়’। শওকত ওসমানের লেখা বইটি প্রকাশ হবার বহুদিন পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এর আবেদন কমেনি। পাঠকরা এখনো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইয়ের তালিকায় এটিকে প্রথমদিকে রাখেন। এছাড়া আহমদ ছফার ‘আলাতচক্র’ এবং ‘ওঙ্কার’ বই দুটোই সমালোচকদের কাছে বেশ প্রশংসিত। ওঙ্কার বইটি প্রকাশ হয়েছিলো ১৯৭৫ সালে। যেই গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলো তারই একটি প্রতীকী প্রকাশ হিসেবে ওঙ্কার বইটিকে গণ্য করা হয়। অপরদিকে আলাতচক্র বইটিতে উঠে এসেছে মুক্তযুদ্ধকালীন সময়ে শরণার্থী শিবিরে থাকা মানুষের জীবনের গল্প।

তবে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাসে যেই বইকে কখনই এড়িয়ে যাওয়া যায় না, সেটি হলো সেলিনা হোসেনের লেখা ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। এটি যেন যুদ্ধ পরবর্তীতে জন্ম নেয়া মানুষকে নতুন করে যুদ্ধ দেখিয়েছিলো বইয়ের মাধ্যমে। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে বইটির উপর ভিত্তি করে সিনেমা তৈরী করেন বরেন্য নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই বের হয়েছিলো ১৯৮৬ সালে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা ‘চিলেকোঠার সেপাই’। এদের বাইরেও আনিসুল হক লিখেছেন একটি চমৎকার বই ‘মা’। যেটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লেখা সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বিক্রিত বইয়ের একটি। ইংরেজি সহ অনেকগুলো ভাষায় মা বইটি অনুবাদ করা হয়েছে। একজন শহীদের মায়ের আত্মত্যাগ ও ছেলের প্রতি গভীর মমত্ব বইটিকে এমনভাবে শক্তিশালী করেছে যে, পাঠক যেন স্বয়ং শহীদ আজাদের মা’কে খুব কাছ থেকে দেখতে পাবে। সম্প্রতি ‘মা’ বইটির একশোতম সংস্করন প্রকাশ পেয়েছে।

সবশেষে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ফিকশন লিখেছেন এমন একজন লেখকের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই একাধিক। এছাড়াও তার সেসব গল্প বা উপন্যাসকে কেন্দ্র করে নির্মান করা হয়েছে সিনেমা। ২০০৪ সালে প্রকাশ হওয়া হুমায়ূন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বইটি বাংলাদেশে বেশ সাড়া ফেলেছিলো। পাঁচশো আঠাশ পৃষ্ঠার বিশাল কলেবরের বইটিতে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদের ‘১৯৭১’ নামের ছোট কলেবরের বইটিও বেশ পাঠকপ্রিয় হয়েছিলো। এছাড়া হুমায়ূন আহমেদের জীবনের শেষ উপন্যাস ‘দেয়াল’ বইটিকে ঘিরে অনেক প্রশ্ন ও বিতর্কের জন্ম দিলেও, এটিও রচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটি ঐতিহাসিক সময়কে ঘিরে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক বইসমুহ পেতে ক্লিক করুন।
নিজের দেশের ইতিহাস মুলত নিজের পরিচয়ের একটি ধাপ। আমরা মুক্তিযুদ্ধে উপস্থিত না থেকেও নিজের দেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্ব করি। কারণ আমরা এই দেশেরই অংশ। তাই দেশকে জানতে কিংবা নিজেকে জানতে চমৎকার বুননশৈলিতে তৈরি করা বইগুলো আসলে আমাদের নিজেদেরকে নতুন করে চিনতে সাহায্য করবে।