একসময় গ্রীষ্ম অথবা শীতের ছুটির খুব পরিচিত একটি দৃশ্য ছিলো দাদু কিংবা নানুকে ঘিরে বসে থাকা ছোট ছেলে-মেয়েদের একটি দল। তাদের একটিই আবদার- গল্প শোনাতে হবে। সেই মায়াকাড়া চোখগুলোর আকুল মিনতি বাড়ির এই বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটি কখনোই ফেলতে পারতেন না। ফলে তাকে খুলতে হতো গল্পের ঝাঁপি। হতে পারে এই গল্পগুলো বেশ পুরোনো, যা সময়ের বিবর্তনে ভিন্ন রূপ নিয়েছে, হতে পারে প্রতিরাতে একই গল্পের পুনরাবৃত্তি যা বংশানুক্রমে প্রবর্তিত হচ্ছে।
গল্পগুলোর মাঝে মিল ছিলো একটি জায়গায়, রসে ভরা গল্পগুলো আরো রসিয়ে উঠতো বলার ধরনে, তবে সেই রসের সাথে শিশুরা গ্রহণ করতো নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা। পরিবারের এই বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি সন্তর্পণে পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করতেন। মমতা মেশানো সেই গল্পগুলো শিশুদের কোমল মনে গভীর রেখাপাত করতো, তারা স্বপ্ন দেখতে শিখতো পাশাপাশি তারা জানতে পারতো পূর্বপুরুষের নানা কিচ্ছা সম্পর্কে। গল্পগুলোর আরেকটি বিষয় ছিলো ধর্মীয় শিক্ষা। গল্পের ছলে তারা স্বীয় ধর্মের প্রকৃতিকে জানতে পারতো। নানা মহিয়সীর জীবনগাঁথা থেকে নিজেরা অনুপ্রাণিত হতো।
তবে যুগের তালে সমাজব্যবস্থাও আমাদের অগোচরে বদলেছে। পরিবারগুলো হয়েছে খণ্ড-বিখণ্ড। পরিবারের সদস্যদের ভূমিকাতেও তাই লক্ষ্য করা গেছে আমূল পরিবর্তন। যে শিক্ষা পরিবার থেকে শিশুদের পাওয়ার কথা, তা তাদের খুঁজে নিতে হচ্ছে পাঠ্যপুস্তক থেকে কিংবা আশ্রয় নিতে হচ্ছে মকতব অথবা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছে। এমনকি মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা একটি পাঠ্যবিষয় রূপে স্থান পেয়েছে। এই পদক্ষেপের প্রতি বিভিন্ন ব্যক্তির অভিমত ভিন্ন ভিন্ন, কারো নেতিবাচক তো কারো ইতিবাচক। তবে এই শূন্যস্থান পূরণে বিকল্প পন্থা খুঁজে বের করতে হতোই এবং এক্ষেত্রে বইয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি তাই নজর দেওয়া হলো গল্পের বইগুলোতেও। সচেতন অনেক ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে আসলেন সমাজের এই সংবেদনশীল দিকটিকে সামলাতে। কেননা একটি দেশের কিংবা সমাজের অগ্রগতি অনেকটাই নির্ভর করে সে সমাজের শিশুদের বিকাশের উপরে। শিশুরা যে শিক্ষা নিয়ে বড় হবে, তাদের আগামী দিনগুলোও সে অনুযায়ী গঠিত হবে।
বিজ্ঞানীদের মতে, ১-৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মেধা বিকাশের গতি থাকে সর্বোচ্চ। ফলে তারা সেসময় যে শিক্ষাটি পেয়ে থাকে তা-ই তাদের পরবর্তী জীবনে প্রতিফলিত হয়। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন আদর্শ বই। মনোবিজ্ঞানীদের মতে শিশুরা ঐ সকল বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয় যাতে থাকে বিচিত্র রঙের বাহার, নানা ছবি আর সহজ সাবলীল ভাষা। অর্থাৎ একটি বইয়ের বিষয়বস্তু শিশুদের বিকাশ তরান্বিত করার উপযোগী হলেই চলবে না, বইটিকে হতে হবে সুখপাঠ্য এবং শিক্ষণীয় বিষয়গুলো লিখা থাকতে হবে সহজ ভাষায় গল্পের মতো করে, তবেই শিশুরা বইটিকে বেছে নেবে।
একসময় বাংলা সাহিত্যের জগতে শিশুদের পাঠ্য উপযোগী ধর্মীয় বইয়ের অভাব ছিলো। সাধারণত ধর্মীয় বইয়ের বিষয়বস্তু হয়ে থাকে ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ, ফলে স্বাভাবিকভাবেই শিশুদের নিকট তা বোধগম্য নয়। ইসলামী ইতিহাসের নানা বিষয়, নানা মনিষীর বিচিত্র জীবনের ইতিহাস, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জীবনের নানা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, বিভিন্ন হাদিস তাই শিশুদের অজানা থেকে যায়। আমাদের মুসলিমদের নিকট সর্বোচ্চ জ্ঞানের ভাণ্ডার হলো আল-কুরআন এবং এর পরই স্থান পায় হাদিস। আল-কুরআন আমাদের দিক নির্দেশনা দেয় আর হাদিস হলো মহানবী (সা)-এর মুখনিঃসৃত বাণী এবং তাঁর কাজকর্মের বিবরণ। হাদিস থেকেই মূলত দৈনন্দিন জীবনের নানা বিষয়ের শিক্ষা পাওয়া যায়।
প্রাপ্তবয়স্করা এই জ্ঞান সহজে আহরণ করতে পারলেও তা ছিলো শিশুদের নাগালের বাইরে। লেখকেরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন শিশুদের জীবনে নৈতিকতা, মানবিকতার অপূর্ণতার কারণ। তারা সচেতন হলেন বলেই বাংলা সাহিত্যের জগতে সুখপাঠ্য কিছু শিশুতোষ ধর্মীয় বইয়ের সৃষ্টি হলো। শিশুরা ইসলাম ধর্মের নানা দিক সম্পর্কে জানতে পারলো, শ্রেষ্ঠ মানব হযরত মোহাম্মদ (সা) এর নানা কাজ এবং সেগুলোর মাজেজা সম্পর্কে জানতে পারলো। এছাড়া কুরআনে বর্ণীত বিভিন্ন নির্দেশনা অমান্যকারী জাতির করুণ পরিণতি সম্পর্কে অবগত হলো। বিশেষ করে শিশুদের মানবিকতাবোধ বোধ জাগ্রত করা, শুদ্ধ-ভুলের মাঝে তফাত শেখানো, আচার-আচরণে অমায়িকতা এবং খারাপ কাজের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন করতে এই বইগুলোর বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
গল্পে গল্পে শিশুদের ধর্ম নিয়ে জানাবে এমন কিছু বইয়ের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। পিতা-মাতারা তাদের শিশুদের মানসিক বিকাশকে তরান্বিত করতে যেমন এগুলো বেছে নিতে পারেন, তেমনি উপহার হিসেবেও এগুলো সকলের পছন্দের তালিকায় থাকবে। এরকম দুটি সিরিজ এবং তিনটি বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেওয়া হলো এই লেখায়।

১) ছোটদের ঈমান সিরিজ
সমর্পণ প্রকাশনী থেকে বাংলায় এই ইমান সিরিজটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালে। এই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত হলো মোট ৬টি বই, যথা- ‘আসমান থেকে এলো কিতাব’, ‘ফেরেশতারা নূরের তৈরি’, ‘বিচার হবে আখিরাতে’, ‘আল্লাহ আমার রব’, ‘দুনিয়ার বুকে নবী রাসূল’, ‘নাম বোঝা যায় না’ । এই সিরিজের শরঈ সম্পাদনা করেছেন শাইখ আবদুল হাই মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ। এই সিরিজটি প্রকাশের পেছনে মূল উদ্দেশ্য কোমলমতী শিশুদেরকে গল্পের ছলে ইমান শেখানো। তাই এর বিষয়বস্তুও ঐ অনুসারে নির্ধারিত হয়েছে। প্রতিটি বইয়ে কুরআন, হাদিস এবং তাফসির গ্রন্থসমূহকে অবলম্বন করে আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, রাসূল, আখিরাত এবং তাকদীর বিষয়ে গল্প লিখিত হয়েছে। এই সিরিজের আরেকটি আকর্ষণ হলো গল্পের সাথে থাকা রঙিন রঙিন ছবি। বলা যায়, শিশুদের ইমান সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা দিতে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ।

২) গল্পে আঁকা ইতিহাস
এটি মূলত একটি অনুবাদ সিরিজ। আরবের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সমাজতত্ত্ববীদ শাইখ আলী তানতাভীর (রহ.)-এর বিখ্যাত ও শিক্ষামূলক শিশুদের পাঠের উপযোগী ৭টি বইকে ৭টি খণ্ড হিসেবে ধরে এই সিরিজটি তৈরি করা হয়। বাংলায় অনুবাদের এই মহান দায়িত্বটি পালন করেন অনুবাদক মাওলানা ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী। সিরিজটিতে অন্তর্ভূক্ত ৭টি খণ্ড- ‘আঁধার রাতের বন্ধু’, ‘অপরাধী ও পুলিশ’, ‘দরজি ও সেনানায়ক’, ‘দুই ভাইয়ের গল্প’, ‘দুই সাওদাগরের কাহিনী’, ‘আঙুর ও মন্ত্রিত্ব’ এবং ‘মন্ত্রীর ছেলে’। এই বইটিতে সাবলীল ভাষায় ইতিহাসকে উপস্থাপন করা হয়েছে। বলতে গেলে আগা গোঁড়াই একটি গল্পের বই তবে গল্পগুলো ইতিহাসের পাতা থেকে নেওয়া ফলে শিশু কিশোরেরা এটি পড়ার মাধ্যমে প্রকৃত মুসলমানদের কর্ম এবং ইমান সম্পর্কে অবগত হবে।

৩) গল্পে আঁকা সিরাত
আবদুত তাওয়াব ইউসুফের রচিত এই গ্রন্থটি বাঙালি শিশু কিশোরদের পাঠ উপযোগী করে তোলেন মাওলানা ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী। ইসলামের শিক্ষা বা ইতিহাস নিয়ে এই বইটির গল্পগুলো লেখা নয়। আমাদের নবীজির জীবনে ঘটে যাওয়া তাৎপর্যপূর্ণ নানা ঘটনা এক ভিন্ন গদ্যরীতিতে এই বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে। ভিন্ন এই কারণে যে, গল্পগুলোর কথক কোনো ব্যক্তি কিংবা লেখক নিজে নন। ঘটনাগুলোতে স্থান পাওয়া নানা জীব ও জড় বস্তু এখানে গল্প কথকরূপে আবির্ভূত হয়েছে। লেখক আবরাহার হাতি, মা হালিমার বাহন, হাজরে আসওয়াদ, লাইলাতুল কদর, তায়েফ নগরীর আঙ্গুর, উট, নবীজির বাহন বোরাক, উটনী কাসওয়া, ওহুদ পাহাড়, রিদোয়ান বৃক্ষ ইত্যাদি চরিত্রের জবানীতে ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করেছেন, পাশাপাশি ফুটিয়ে তুলেছেন নবীজির প্রতি ভালোবাসাকে।

৪) দি প্রফেটস
সূচিপত্র প্রকাশনা থেকে ২০১৯ সালে সৈয়দ আলি আশরাফের এই বইটি বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়। বইটি অনুবাদ করেন ডঃ রহমান হাবিব। ইসলামের একেবারে সাধারণ বিষয়গুলো এই বইয়ে সহজ ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে। বইটি শুরু হয়েছে মানুষের সৃষ্টি কেন ও কী করে হলো এই উত্তর দেওয়ার মধ্য দিয়ে। বইয়ের নামটির মধ্যেই এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বিভিন্ন নবী এবং তাদের জীবনীকে সংক্ষিপ্ত আকারে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। হযরত আদম (আঃ), হযরত নূহ (আঃ), হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত ইউসুফ (আঃ), হযরত মুসা (আঃ), হযরত দাউদ (আঃ), হযরত সোলাইমান (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে শিশু-কিশোরেরা জানতে পারবে এই বইটি পড়ার মধ্যে দিয়ে।

৫) সবুজ গম্বুজের ছায়া
২০১৫ সালে শরীফ মুহাম্মদের এই বইটি প্রকাশিত হয়। লেখক সাবলীলভাবে পুরো গ্রন্থটিতে নানা উপমার ব্যবাহার করেছেন। সাথে বোনাস হিসেবে ছিলো কাব্যশয়ী গদ্যরীতির ব্যবহার। ১৯টি কাহিনী তিনি উপস্থাপন করেছেন এই বইটিতে, যাতে নবী-রাসূলের পাশাপাশি সাহাবা, তাবেই এবং অলি-আওলিয়াদের গল্প তিনি বলে গেছেন পর্যায়ক্রমে। বইটি পড়ার মাধ্যমে শিশুদের হাদিস সম্পর্কে জ্ঞান বাড়বে। এছাড়া লেখকের রচনাশৈলী শিশুর সৃজনশীলতার গুণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
সবগুলো বই একসাথে পেতে ক্লিক করুন।
1 thought on “আপনার সন্তানকে ইসলামের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ৫টি আদর্শ বই”
Pingback: শিশু-কিশোরদের প্রতি প্রিয়নবী (সা.) এর স্নেহাশিস আচরণ - রকমারি ব্লগ