সভ্যতার সূচনায় ধীরে ধীরে গড়ে তোলা হয়েছে একেকটি সমাজব্যবস্থা। এই সমাজব্যবস্থায় কেন্দ্রের ভূমিকাটি পালন করেছে পরিবার। পরিবার শুধু যে সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের একক, তা কিন্তু নয়। এরই সাথে সমাজের সবচেয়ে সফলতম প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝেও অন্যতম। শিশুর জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, তার লালন-পালন, চরিত্র গঠন ও তাকে সমাজের যোগ্য সদস্যে পরিণত করে তোলার কারখানাও বলা চলে পরিবারকে। শিশুর মানসপটে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে যায় তার পরিবার ও পরিবারের লালিত চিন্তাভাবনা-দৃষ্টিভঙ্গি। সেটিই আদর্শ শিশুর বিশ্বাসের ভিত গড়ে দেয়। পরিবার নামক এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে সমাজের ভবিষ্যৎ প্রতিনিধিকে, যারা পরবর্তীতে তৈরি করে আরেকটি প্রজন্ম। ইসলামের আলোকে সামাজিক কিংবা পারিবারিক জীবন গড়তে হলে জানতে হবে ইসলামী বিধিমালা, সেজন্যে পড়তে হবে ইসলামী বই ।
পরিবার গঠনের মূলে যে উদ্দেশ্য রয়েছে তা জৈবিক হিসেবে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা হলেও এর প্রকৃত অর্জন আরো অনেক বিস্তৃত। এই অর্জন হলো স্নেহ ও ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও শ্রদ্ধা এবং দায়িত্বশীলতার আদর্শ নিজের মাঝে পরিস্ফুটিত করা। স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে তৈরি হয়ে ওঠে একেকটি পরিবার, যার সূচনা হয় নর-নারীর বিয়ের মাধ্যমে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও স্ত্রী সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে নিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রতিশ্রুতি থাকে পরস্পরকে মানসিক ও সার্বিকভাবে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে চলার, ভালোবাসা ও স্নেহের সামাজিক স্বীকৃতিতে নিজেদের জীবন সাজিয়ে তোলার।
পরিবারের সূচনাতেই শুরু হয় একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধের অনূভুতি। এই দায়িত্ববোধ ও শ্রদ্ধাবোধ যদি অন্তরে জন্ম না নিতে পারে, তবে সমগ্র জীবন বয়ে বেড়াতে হতে পারে এর কুফল। দাম্পত্যজীবনের এই ব্যর্থতা জীবনকে করে দিতে পারে আলো-বাতাস ছাড়া এক গুমোট ঘরের মতো, যাতে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাওয়া দায়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সমস্তটাই যেন নির্ভর করে দাম্পত্য জীবনে নিজের করণীয় সম্পর্কে অবগতির ওপর। কীভাবে এই জীবনকে সুখী করে তোলা যায়, সফলতা লাভ করা যায় এবং সামাজিকভাবে সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ করা যায় একটি সফল দম্পতি হিসেবে তার পরিপূর্ণ বিবরণ ও দিকনির্দেশনা পাওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট আধেয় হলো পবিত্র কোরআন।
এরপরই আসে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) হতে আগত হাদিস শরীফ। আল্লাহর বাণী কুরআনুল কারীমে আল্লাহ মানবজীবনের প্রয়োজনীয় সব বিধি-বিধান প্রণয়ন করেছেন। আল্লাহর রাসূল নবী করিম (স) বিভিন্ন হাদীসে সেই বিধানের বিশদ বিবরণের সাথে সুখী দাম্পত্যজীবনের জন্য করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্যের বিবরণও পাওয়া যায় হাদীস সমূহে।
একটি বিয়ে শুধুই দুটো মানুষের একসাথে বসবাসের দলিল নয়, যেমনটা আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে এখনকার তরুণ-তরুণীরা ভাবতে শুরু করেছে। বিবাহবন্ধন হলো পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দুজন মানুষের সুস্থ, স্বাভাবিক ও সুখী জীবনের সামাজিক স্বীকৃতি। বিয়ের পর শুরু হয় আসল পরীক্ষা, সব ঝড়-ঝঞ্চা মোকাবেলার ভারটা থাকে স্বামী-স্ত্রী দুজনের ঘাড়েই।
সংসারধর্ম পালন করতে গিয়ে পদে পদে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। এসকল চড়াই-উৎরাই পার করতে সাহেব-বিবি দুজনারই সমান পরিশ্রম করতে হয়। একে অপরকে সকল মুশকিলের সময় সাহায্য করতে হয়, রাখতে হয় প্রেমপূর্ণ মধুময় সম্পর্ক। তবে এর মাঝেও আসে নানা টানাপোড়েন, হতে পারে মতের অমিল। এর ফলে পরিবারে অশান্তির সৃষ্টি হয়, ফাটল ধরতে থাকে সম্পর্কে। এমন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে সম্ভাবনাময় এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়া দম্পতির সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়।
বৈবাহিক জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবও দাম্পত্যকলহ ও অশান্তি বয়ে আনতে পারে, যার ফলস্বরুপ বিচ্ছেদের মতো দুঃখজনক পরিণতি আসার পরিস্থিতিও তৈরি হয়। এমন পরিণতি থেকে নিজের সুন্দর সম্পর্ককে নিরাপদ রাখতে দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবেলা ও একই সাথে খুব মৌলিক করণীয়গুলো জেনে রাখা খুব জরুরি।
ইসলামিক বিধি-বিধান ও এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যে কয়েক যুগেই বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। ইসলামিক চিন্তাবিদদের সুনিপুণ গবেষণা ও প্রজ্ঞার প্রকাশ পেয়েছে এসব বইয়ে। আধুনিক যুগের যুবসমাজের কাছে এসব বই সহজলভ্য ও সহজবোধ্য করে তোলার লক্ষ্যই এক্ষেত্রে মুখ্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। সহজ ও সাবলীল ভাষায় রচিত এসব বইয়ে দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবং তাদের উৎস সম্পর্কেও বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

১. ইসলামী দাম্পত্য জীবন
মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম রচিত ‘ইসলামী দাম্পত্য জীবন‘ ব্যক্তিগত বিকাশ ও পারিবারিক বিধিবিধান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সম্বলিত একটি বই। এতে লেখক সৃষ্টির শুরুতে নর-নারীর সৃষ্টি এবং তার পেছনের কারণ ও ইতিহাস, হযরত আদম (আ) ও বিবি হাওয়া (আ) এর বিয়ে ও পরিবার, দাম্পত্যজীবনের গুরুত্ব, পরিবার গঠনের উদ্দেশ্য, ইসলামী পরিবারের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পরিবারের প্রকারভেদ এবং পরিবারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় সম্পর্কেও জানানো হয়েছে। ইসলামী বিয়ের মাধ্যমে শরীয়াহ মোতাবেক পরিবার গঠন পদ্ধতির বিস্তারিত জ্ঞানেরও এখানে সন্নিবেশ হয়েছে। বিবাহ পূর্ববর্তী, বিবাহ সম্পন্নকরণ ও বিবাহ পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন নিয়মনীতি সম্পর্কে দিকনির্দেশনা সংযোজিত হয়েছে। নিষিদ্ধ বিবাহ থেকে তালাকের নিয়ম-কানুনের বিশদ আলোচনা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। আছে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সমতা বিধানের নীতির আলোচনাও। লেখক মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

২. আদর্শ স্ত্রীর পথ ও পাথেয়
ইসলাম ধর্মে নারীকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ মর্যাদার স্থান। একজন কন্যা হিসেবে, একজন স্ত্রী হিসেবে, এবং একজন মা হিসেবে নারীকে শ্রদ্ধা, সম্মান ও মর্যাদার পাত্র হিসেবে দেখা হয়। একজন নারীর একজন আদর্শ স্ত্রী হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে যে সমস্ত প্রচেষ্টা ও কৌশল থাকে তা এই বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে। মুফতী রুহুল আমিন যশোরী রচিত আদর্শ স্ত্রীর পথ ও পাথেয় এই বইটিতে একজন নারীর স্বামী, পরিবার ও সংসারের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কোন পথে চললে সংসার শান্তিপূর্ণ হবে, কীভাবে নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে সমাধা করে মহান আল্লাহ তা’আলার প্রিয় হওয়া যায় তা এই বইয়ের মূল উপজীব্য। লেখক নৈপুণ্যের সাথে কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত উপায়ে আদর্শ জীবনসঙ্গিনী হওয়ার পথ সম্পর্কে করণীয় ফুটিয়ে তুলেছেন।

৩. হে আমার মেয়ে
বিংশ শতকে ইসলামিক লেখক ও গবেষকদের মাঝে এক উল্লেখযোগ্য নাম হলো শায়েখ আলী বিন মুস্তাফা আত-তানতাবী। সিরিয়ার দামেস্কে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। বাস্তবতা ও প্রতিকূলতার সাথে লড়াইয়ে টিকে থেকে তিনি দুঃসাহসিকতার সাথে নিজের লেখার কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁর লেখা ‘হে আমার মেয়ে‘ নামক ইসলামী বই টিতে তিনি ছন্দের সাথে বেশ আকর্ষণীয়ভাবে বক্তব্যের মতো ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর মর্যাদার স্থানকে উপস্থাপন করেছেন। এরকম একটা ইসলামী বই কেন পড়বেন? বইটির বিশেষত্ব হলো এখানে তিনি ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোয় তাঁর ভ্রমণের সুবাদে অর্জিত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে তিনি নারীদের ইসলাম প্রণীত জীবনপদ্ধতি অনুসরণের উপদেশ দিয়েছেন। কাব্যের সুরে গদ্য লিখে বইটিকে সুখপাঠ্য করে তুলেছেন তিনি।

৪. কুররাতু আইয়ুন: যে জীবন জুড়ায় নয়ন
ডা. শামসুল আরেফীন রচিত ‘কুররাতু আইয়ুন: যে জীবন জুড়ায় নয়ন‘ একটি গবেষণাধর্মী ইসলামী বই । বইটিতে ইসলাম ধর্মের গোড়াপত্তন থেকে বর্তমান সময়ের মাঝে সময়ের যেসব পরিবর্তন হয়েছে তার ধারণা দেওয়া হয়েছে। তারপরই এসেছে বিবাহ, পরিবারের সুখ-শান্তি অটুট রাখার পন্থা, সন্তান জন্ম হওয়া থেকে শুরু করে তার লালন পালনের বিধান, সঠিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অনুশীলনের মাধ্যমে সন্তানকে আদর্শ মানুষে পরিণত করার পন্থা ও নাস্তিকতার ভয়াবহতা থেকে নিজেকে দূরে রাখার শিক্ষা। ইসলামিক জীবনদর্শনের ভ্রান্ত ধারণা থেকে আধুনিক যুব সমাজকে সরিয়ে আনার জন্য স্পষ্ট ও সহজ ভাষায় যুক্তিতর্ক দিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই ইসলামী বই টিতে।
ইসলামী বইসমূহ পড়তে
1 thought on “ইসলামের আলোয় সুন্দর হোক দাম্পত্য জীবন”
Pingback: সুদ সম্পর্কে একজন মুমিনকে অবশ্যই যা জানতে হবে । - রকমারি ব্লগ