দয়া, কল্যাণ, মমতা ও ভালোবাসা মানুষের মহৎগুণ। এমন কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না যার মনে দয়া-মায়া, মমতা ও ভালোবাসা নেই। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা সহজাত একটি বিষয়। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার গুণ দিয়েই আল্লাহ পাক মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাইতো মানুষ মানুষকে ভালোবাসে। মানুষ মানুষকে করুণা করে। কিন্তু যিনি মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, যাকে আল্লাহ পাক মানবকল্যাণের জন্য পাঠিয়েছেন, দয়া, মমতা ও ভালোবাসার আধার বানিয়েছেন- মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও সহমর্মিতা কী পরিমাণ ছিল তা কল্পনা করা যায় না। যিনি ভালোবাসতেন ধনীকে এবং গরিবকেও। নারী এবং পুরুষকেও। গাছপালা, পশুপাখি এবং সৃষ্টিজীবের প্রতিটি প্রাণীকেও। যার ভালোবাসা ছিল সবার জন্য এবং সবকিছুর জন্য অবারিত, অকৃত্রিম। তিনি হলেন আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কেমন ছিল, মানুষের কল্যাণচিন্তায় তিনি কেমন ব্যাকুল ও অস্থির হতেন, তিনি কিভাবে ভালোবাসতেন আপনজনদের, আপন করে নিতেনে দূরের লোকদের। তিনি যেভাবে ভালোবাসতেন- সে সম্পর্কেই কিঞ্চিৎ আলোচনার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
নবীজি সা. সকল মানুষকে সত্য ও সঠিক পথে পরিচালনার জন্য ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে, দরদ ও মমতামিশ্রিত কণ্ঠে আহ্বান করেছেন। তিনি নিজেকে এতটাই উজাড় করে দিয়েছেন, যা দেখে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করেছেন, ‘হে নবী আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি আপনার ওপর কুরআন নাজিল করিনি।’ [সুরা তাহা : ২]
নিজে শত কষ্ট সয়েছেন। যন্ত্রণার পাহাড় বইয়ে বেড়িয়েছেন। তারপরও একজন মানুষও যেন কোনোভাবেই জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ না হয়, দরদি নবীর এটাই ছিল সার্বক্ষণিক কামনা। এমনই ছিল মানুষের প্রতি তাঁর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। কেননা তায়েফের ময়দানে তাঁর ওপর নির্মম নির্যাতনের পর যখন পর্বতমালার ফেরেশতা নবীজি সা.কে আওয়াজ দিলেন এবং সালাম দিয়ে বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ! আপনার সম্প্রদায় আপনাকে যা করেছে, তার সবই মহান আল্লাহ দেখেছেন। আমি হচ্ছি পর্বতমালার ফেরেশতা। আমার প্রভু আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন, যেন আপনি আমাকে তাদের ব্যাপারে [কোনো] নির্দেশ দেন। সুতরাং আপনি কী চান? আপনি চাইলে, আমি [মক্কার] বড় বড় পাহাড় দুটিকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেব।’ [এ কথা শুনে] নবীজি সা. বললেন, [এমন কাজ করবেন না] বরং আমি আশা করছি যে, মহান আল্লাহ তাদের পৃষ্ঠদেশ থেকে এমন লোকের আবির্ভাব ঘটাবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। [বুখারি : ৩২৩১]
মহান আল্লাহ উম্মতের প্রতি রাসুলের দয়ার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসুল এসেছেন, যিনি তোমাদের ব্যথায় কষ্ট পান, তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।’[সুরা তাওবা : ১২৮]
তিনি মানুষের যে কোনো কষ্ট-ব্যথা অনুভব করেন। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জাহান্নাম দেখিয়েছেন, জাহান্নামের ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহ তাঁকে জানিয়েছেন। তাই তিনি কখনও এ কামনা করতেন না, মানুষদের [উম্মতের] মধ্যে কেউ আল্লাহর অবাধ্য হয়ে জাহান্নামি হোক। কেউ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঈমান আনলে তিনি কতটা উচ্ছ্বসিত হতেন, তা এই চিত্র থেকে প্রতীয়মান হয়। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, এক ইহুদি বালক নবীজি সা. এর খিদমত করত। সে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে নবীজি সা. তাকে দেখার জন্য আসলেন। তিনি তার মাথার কাছে বসে তাকে বললেন- তুমি ইসলাম গ্রহণ কর। সে তখন তার পিতার দিকে তাকাল, যে তার কাছেই ছিল। পিতা তাকে বলল, আবুল কাসেম [নবীজি সা. এর কুনিয়াত] এর কথা মেনে নাও। তখন সে ইসলাম গ্রহণ করল। নবীজি সা. সেখান হতে বের হয়ে যাওয়ার সময় ইরশাদ করলেন- সব প্রশংসা সে আল্লাহর, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন। [বুখারি : ১৩৫৬]
প্রিয়নবী সা. দোয়ার সময় সর্বদা উম্মতের কথা স্মরণ করতেন। সবার জন্য তাঁর মন থাকত ব্যাকুল। তাই প্রতিদিন প্রত্যেক সালাতের পর উম্মতের গুনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তিনি। উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা রা. বলেছেন, ‘রাসুল সা. এর অন্তর প্রসন্ন দেখলে আমি বলতাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমার জন্য দোয়া করুন।’ তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আয়েশার আগে ও পরের, গোপন ও প্রকাশ্যে করা গুনাহ ক্ষমা করুন।’রাসুল সা. এর দোয়া শুনে আয়েশা রা. হেসে নিজের কোলে মাথা নিচু করে ফেলতেন। তাঁর হাসিমাখা মুখ দেখে রাসুল সা. বলতেন, ‘আমার দোয়াতে কি তুমি আনন্দিত হয়েছ?’ আয়েশা রা. বলতেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এটা কেমন কথা, আপনার দোয়ায় আমি আনন্দিত হব না?’ তখন রাসুল সা. বলতেন, ‘আল্লাহর শপথ! এভাবেই আমি প্রত্যেক সালাতের পর আমার উম্মতের জন্য আমি দোয়া করি।’[ইবনে হিব্বান : ৭১১১]
উম্মতের অনাগতদের প্রতি নবীজি সা. এর ছিল অগাধ ভালোবাসা। কেননা তারা না দেখেই রাসুলের জন্য সাক্ষ্য দেবে। তাই তাদের দেখার বাসনা ছিল তাঁর। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন, ‘আমার ভাইদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছা করছে।’সাহাবীরা বলল, আমরা কি আপনার ভাই নই? রাসুল সা. বললেন, ‘তোমরা তো আমার সাহাবী তথা সঙ্গী। আমার ভাই হলো, যারা আমার ওপর ঈমান আনবে; কিন্তু আমাকে দেখবে না।’[মুসনাদে আহমাদ : ১২৭১৮]
নবীজি সা. এর সবচেয়ে আপনজন ছিলেন তাঁর স্ত্রীগণ! তিনি তাদের সঙ্গে মধুর ও ভালোবাসাময় জীবন কাটিয়েছেন। ছোট স্ত্রী হযরত আয়েশা রা. এর সঙ্গেও ছিল তাঁর প্রেমময় দাম্পত্য জীবন। আয়েশা রা. এর সঙ্গে তিনি সমবয়সী স্বামীর মতোই আচরণ করেছেন। ছোট্ট আয়েশা রা. খেলাধুলা করেছেন, হাস্যকৌতুকে মেতেছেন। খেলাচ্ছলে কখনো দৌড়িয়েছেন, এক পাত্রে খেয়েছেন, পান করেছেন। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, ‘আমি রাসুল সা. এর সঙ্গে একবার দৌড় প্রতিযোগিতায় আগে চলে গিয়েছিলাম, পরে আমি স্বাস্থ্যবান হয়ে যাওয়ার পর দৌড়ে তিনিই বিজয়ী হলেন। রাসুল সা. তখন বলেন, এ বিজয় সেই পরাজয়ের বদলা। [আবু দাউদ : ২৫৭৮] এ হাদিস থেকেও স্ত্রীদের প্রতি নবীজি সা. এর নিখুঁত ভালোবাসা পরিস্ফুটিত হয়। কারণ ভালোবাসা ছাড়া স্ত্রীদের সঙ্গে এমন মধুর প্রতিযোগিতা হয় না।
নবীজির ভালোবাসার আরেকটি দৃ্ষ্টান্ত তুলে ধরছি। নবীজি সা. মা আমিনাকে হারিয়েছেন শৈশবে। দুধ মা হালিমাকে তিনি আজীবন মায়ের মতোই সম্মান করেছেন ও ভালোবেসেছেন। নিজের চাদর খুলে তাঁকে বসতে দিয়েছেন। সাধ্যমতো তাকে সাহায্য করেছেন এবং উপঢৌকন পাঠিয়েছেন সন্তানের মতোই। তাছাড়া উম্মু আইমান রা. ছিলেন নবীজি সা. এর জীবনের আরেক শ্রদ্ধেয় নারী। ক্রীতদাস ছিলেন এই সাহাবী। নবীজি সা. তাঁকে মা বলে ডাকতেন এবং মায়ের মতোই ভালোবাসতেন। নবীজির জন্মের পর তিনিই প্রথম তাঁকে কোলে নেন। নবীজি সা. তাঁকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি তাঁকে ছেড়ে যাননি। নবীজি সা. ও খাদিজা রা. তাঁকে বিয়ে দেন মধ্যবয়সেই। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর নবীজি সা. সাহাবীদের বলেছিলেন, তোমাদের মধ্যে কে এই বেহেশতি নারীকে বিয়ে করতে চাও, তখন জায়েদ বিন হারিসা রা. তাঁকে বিয়ে করেন।
তিনিই আমাদের প্রিয় নবীজি সা.। যিনি কেয়ামতের ময়দানে সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে বলতে থাকবেন ইয়া উম্মাতি, ইয়া উম্মাতি। যেখানে অন্যসব নবী বলবেন, ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি। হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. ইরশাদ করেছেন, ‘আমার ও তোমাদের উদাহরণ হলো ওই ব্যক্তির মতো, যে আগুন জ্বালিয়েছে। আর পতঙ্গ ও ফড়িং তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, আর সে ওইগুলোকে আগুন থেকে ফিরিয়ে রাখতে চাচ্ছে। তো আমিও তোমাদের কোমর ধরে তোমাদের আগুন থেকে ফিরিয়ে রাখতে চাই। কিন্তু তোমরা আমার হাত থেকে ফসকে যাও।’ [মুসলিম : ৬০৯৮]
নবীজি সা. তাঁর বিশেষ দোয়াটিও নিজের গুনাহগার উম্মতের সংকটময় অবস্থার জন্য রেখে দিয়েছেন। কেননা রহমতের নবী গুনাহগার উম্মতের প্রতি বিশেষ স্নেহশীল ছিলেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেছেন, ‘সব নবীর এমন কিছু দোয়া ছিল, যা আল্লাহর কাছে কবুল হয়েছে। সব নবী দ্রুত নিজেদের জন্য দোয়া করেছে। আমি তা কেয়ামতের দিন উম্মতের সুপারিশের জন্য গোপন করে রেখেছি। আমার উম্মতের মধ্যে যে আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক না করে মৃত্যুবরণ করবে, সে ইনশাআল্লাহ আমার সুপারিশ লাভ করবে।’ [মুসলিম : ১৯৯]
আমাদের নবীজি সা. মানুষের সঙ্গে উত্তম আচার-ব্যবহার, বিনয়-নম্রতা, ভালোবাসা ও সহমর্মিতায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর অমায়িক ও ভালোবাসাময় ব্যবহারে মুগ্ধ অনুসলিমরাও ইসলামে দীক্ষিত হয়েছেন। আত্মীয়-অনাত্মীয়, কাছের-দূরের সবাইকে তিনি ভালোবাসতেন আপনের মতো। যিনি এমন অনুপম গুণের অধিকারী ছিলেন এবং আমাদের নিয়ে নিরন্তর ভাবতেন- তাঁর প্রতি আমাদের কতটুকু ভালোবাসা দরকার তা কি ভেবে দেখেছি? তাই আসুন আমরাও তাঁকে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসি। কেননা তাঁর অনুসরণ করলে এবং তাঁকে সবকিছু থেকে বেশি ভালোবাসলেই আমাদের জীবন সফল ও স্বার্থক হবে। কল্যাণময় হবে ইহকাল ও পরকাল। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন।