নব্বইয়ের দশক, স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো জ্বলজ্বল করা এক সময়। জাদুর মতো কেটে যাওয়া মুহূর্তগুলো আর কখনো ফিরে আসবে না ঠিকই, কিন্তু স্মৃতির জাবর কাটতে গিয়ে মনের অজান্তেই কিছু চরিত্র, কিছু নায়কোচিত নাম আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে যায়। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে যাদের নিয়ে কল্পনায় ঘোড়া ছোটানো হয়েছে বহুবার, তাদের কি আর এত সহজে ভোলা যায়?
টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে হোক বা বাসায় আসা আত্মীয়ের উপহারস্বরূপ অর্থ দিয়ে হোক, পছন্দের গল্পের বই, যা কি না তখন ‘আউটবই’ নামেই বাবা-মায়ের কাছে বেশি পরিচিত ছিল- তা কিনে ফেলার মতো আনন্দ খুব কমই হয়। কিনে আনার পর নতুন বইয়ের গন্ধ, ছাদে শুকোনো বয়ামের আচারের সাথে তাড়িয়ে তাড়িয়ে গল্প গেলার সেই অলস দুপুর কিংবা বিকেলগুলো দূর দিগন্তে এখনও আমাদের হাতছানি দেয়। তবু যান্ত্রিক নগরজীবন পেরিয়ে সেই হাতছানির দিকে আর ফেরা যায় না। ফেরা যায় না ঠিকই, তবু গল্পের ছলে, মনের ভুলে আমরা বারবার সেখানেই ফিরে যেতে চাই। আজকের লেখার মূল বিষয় নস্টালজিয়া, এই জন্মের মধ্যেই পেরিয়ে আসা অন্য এক জন্মের কথা- নাইন্টিজের শিশু-কিশোরের প্রিয় সাহিত্যের প্রিয় নায়কদের কথা।
মাসুদ রানা
বাংলা সাহিত্যের জেমস বন্ড মাসুদ রানার দুরন্তপনা ভেবে ভেবে নিজেকেও সে জায়গায় রাখেনি এমন কিশোর বিরল। স্পাই- পেশার মধ্যেই যেন অভিযান আর রোমাঞ্চের ঘ্রাণ। আর তা যদি হয় মাসুদ রানার মতো সুদর্শন, আকর্ষণীয় ও দুর্ধর্ষ স্পাই, তবে তো কথাই নেই!

সেবা প্রকাশনী নাইন্টিজ কিডদের অনেক স্মৃতিই দিয়েছে, তার মধ্যে অনন্য স্মৃতি হচ্ছে মাসুদ রানা। কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্ট এই চরিত্রটির প্রথম দেখা মেলে ‘ধ্বংস পাহাড়’ বইয়ে। পেপারব্যাক সেই বইয়েই শিশু-কিশোরেরা খুঁজে পায় তাদের হিরোকে, মাসুদ রানাকে। জেমস বন্ডের চরিত্রানুকরণে সৃষ্টি মাসুদ রানা পুরোটাই যেন বাঙালির, তাকে প্রায়ই দেশ-বিদেশের বহু রোমাঞ্চ অভিযানে বেরিয়ে পড়তে দেখা যায়, রহস্যের কিনারা করতে তার তুলনা নেই। অনেক সময়ই রূপসী তরুণীর সাহচর্যে মাসুদ রানার চরিত্রের রোমান্টিকতা কিশোর মনে প্রথম প্রেমের রঙও মাখায়। মাসুদ রানা নিয়ে লেখা বইয়ের সংখ্যা ৪০০, যা কি না বৃহৎ কলেবরে তাকে প্রতিষ্ঠা করেছে একটি সম্পূর্ণ প্রজন্মের কাছে। তার নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা ‘রানা এজেন্সি’র সদস্য হবার ইচ্ছাও সে প্রজন্মের কিশোরবেলার বহুমাত্রিক রঙিন স্বপ্নের বিশেষ একটি। ১৯৭৪ সালে মাসুদ রানা চরিত্রটির চলচ্চিত্রায়ন হয়, যাতে অভিনয় করেন আরেক মাসুদ রানা- মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা।
তিন গোয়েন্দা
সত্যি করে বলুন তো, ছোটবেলায় তিন গোয়েন্দার সাথে কল্পনার জগতে বেরিয়ে পড়েননি কোনো রহস্যের সমাধান করতে? কখনো দূরদেশে কিশোর, মুসা আর রবিনের চতুর্থ সঙ্গী হতে সাধ জাগেনি? মিশরের পিরামিড, গোপন কোনো গুহা, রহস্যের বেড়াজালে বন্দী সময়ের সাক্ষী হতে চেয়েছেন পাঠক আপনিও।

বইয়ের শুরুতে ‘হাল্লো বন্ধুরা, আমি কিশোরা পাশা বলছি’- নতুন কোনো ভলিউমে পাওয়া এই লাইনটির জন্য কতদিন যে অপেক্ষা করতে হতো, তার ইয়ত্তা নেই। তবে সেই অপেক্ষার ফলাফল হিসেবে সবসময়ই নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চার আমাদের কাছে ধরা দিত পেপারব্যাক সেই বইয়ের মলাটে।
তিন গোয়েন্দার অভিযানের শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৫ সালে, সেবা প্রকাশনীর মাধ্যমে। তরুণ লেখক রকিব হাসানের সৃষ্টি এই তিন গোয়েন্দা। একেবারে মৌলিক রচনা নয়, অনেক বিশ্ববিখ্যাত গোয়েন্দা সিরিজ থেকে ধার করেই লেখা- তবে এই বিষয়টি কোনোভাবেই তিন গোয়েন্দার জনপ্রিয়তাকে খাটো করে দেয় না।
২০০৩ সালের পর রকিব হাসান আর এই সিরিজটি চালিয়ে যাননি। পরবর্তী সময়ে শামসুদ্দিন নওয়াব নামে এক লেখক এটি চালিয়ে গেলেও পাঠকের কাছে ২০০৩ সালেই শেষ হয়ে গেছে সিরিজ, কেননা রকিব হাসানের তুখোড় লেখনী আর ভিন্ন স্বাদের অ্যাডভেঞ্চারের তুলনা তারা খুঁজে পাননি নতুন সিরিজটিতে।
ব্যোমকেশ বক্সী
নিজেকে ডিটেকটিভ বা গোয়েন্দা নয়, সত্যান্বেষী বলতেই ভালোবাসেন ব্যোমকেশ। আর তার সেই সত্যান্বেষণের অভিযানে বন্ধু অজিত সবসময়ের সঙ্গী, প্রায়ই দেখা মেলে সহধর্মিণী সত্যবতীরও। সত্যের সাথে নির্ভীক পথচলার ব্যোমকেশ বক্সী নব্বই দশকেরই শুধু নয়, সব দশকের ছেলেবুড়োরই প্রবল আকর্ষণের স্থান। শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের এই অনবদ্য সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা ঘরানায় অনস্বীকার্য স্থান নিয়ে ভাস্বর হয়ে আছে।

ব্যোমকেশ বক্সীর শুরুটা হয়েছিল ১৯২৪ সালের দিকে, ‘সত্যান্বেষী’ গল্পের মধ্য দিয়ে। এরপর শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের কলম আর থেমে থাকেনি, থেমে থাকেনি ব্যোমকেশের পথচলাও। একে একে পাঠকমহল পেয়েছে ৩৩টি কাহিনী। ব্যোমকেশ বক্সীকে টিভি ও সিনেমার পর্দা- দুটোতেই অনেকবার দেখা গেছে তবে আজ পর্যন্ত নাইন্টিজ কিডদের কাছে ডিডি ন্যাশনালের রজিত কাপুরই আসল ব্যোমকেশ!
কিশোরবেলার সাথে গোয়েন্দা গল্পের কোথাও একটা তালমিল আছে, তা কোনো স্কুলপালানো ছেলের দলই হোক আর আম-কাঁঠালের ছুটিতে নতুন নতুন রহস্য শোঁকার সময়ই হোক। ব্যোমকেশ বক্সীও তাই ‘হিরো’ হয়ে আছেন সেই রোমাঞ্চপ্রেমীদের কাছে, সময় ও স্থানের বেড়াজাল ভেদ করে।
ফেলুদা
বইয়ের পাতাই হোক, সেলুলয়েডের পর্দাই হোক- ফেলু মিত্তিরের তুলনা নেই। সত্যজিৎ রায় বাঙালিকে অনেক কিছুই দিয়ে গেছেন, তবে বোধকরি সবচেয়ে বড় উপহারটা এই মিত্তিরবাড়ির ছেলেটিই। দুই সঙ্গী- জটায়ু আর তপসেকে নিয়ে নব্বই দশকের শিশু-কিশোরদের মনের আঙ্গিনায় লুকোচুরি খেলা প্রদোষ মিত্র ওরফে ফেলুদা বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের সর্বশীর্ষে অবস্থান করা একটি নাম।

১৯৬৫ সালে প্রথমবার ফেলুদার সাথে পরিচিত হয় বাংলার পাঠকসমাজ। ছোটবেলায় পড়া পাশ্চাত্যের শার্লক হোমস ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল সত্যজিতকে, আর তাই বড়বেলায় এই প্রাচ্যেই তিনি গড়লেন এক অবিস্মরণীয় গড়ন- ফেলুদা। ফেলুদার কাহিনীতে থাকা সবক’টি চিত্র লেখক নিজে আঁকতেন, এবং পরবর্তী সময়ে ফেলুদা শুধু বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বড় পর্দায়ও তাঁর মুখর পদচারণা দেখা গেছে। জানা যায়, বিখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে মাথায় রেখেই নাকি ফেলুদার চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলেন লেখক। আর তাই প্রথমবার পর্দায় ফেলুদা হিসেবে আবির্ভূত হন সেই সৌমিত্রই, যদিও বা নাইন্টিজ কিডদের জন্য সব্যসাচী চক্রবর্তীই ‘আসল ফেলুদা’।
কাকাবাবু
একটি ক্রাচকে সঙ্গে নিয়েও কি রহস্য অভিযান পরিচালনা করা যায়? এর উত্তর হবে ‘হ্যাঁ’, যদি তা হন কাকাবাবু। এই ক্রাচকে নিজের দুর্বলতা নয়, সবলতা হিসেবেই উপস্থাপন করেন তিনি; অনেকসময় তা অস্ত্ররূপেও আবির্ভূত হয়। নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করার শিক্ষা দেন কাকাবাবু। তার সবসময়ের সঙ্গী সন্তু কিংবা সন্তুর বন্ধু জোজোর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করেনি, এমন কিশোর পাঠক পাওয়া ভার।

প্রকৃত নাম রাজা রায়চৌধুরী হলেও সন্তুর বদৌলতে আমরা সবাই তাকে কাকাবাবু নামেই জানি। কাকাবাবুর জন্ম ওপার বাংলায়, তবে এপার বাংলা পাঠকদের কাছে তিনি সমধিক পরিচিত ও জনপ্রিয়। চরিত্রটির স্রষ্টা বিখ্যাত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কাকাবাবুর প্রথম আবির্ভাব ঘটে ‘ভয়ংকর সুন্দর’ কাহিনীতে। কাকাবাবুকেও বহুবার চলচ্চিত্রের পর্দায় দেখা গেছে।
এই ছিল নাইন্টিজ কিডদের সেইসব হিরোর কথা, যারা কি না আজও আমাদের শৈশবের স্মৃতি জুড়ে ভাস্বর হয়ে আছেন। শৈশব ও কৈশোরের সেই মোহময় সময়টাতে অ্যাডভেঞ্চার আর রহস্যের জাদু জড়িয়ে দেবার জন্য যাদের কাছে সবসময়ই কৃতজ্ঞ থাকব আমরা।
৯০’স হিরোদের সাথে পরিচিত হতে
comments (0)