ধরুন, আপনি একটি টুরিং টেস্ট দেখতে গেছেন। একজন ফিটফাট পোশাকের সাদা চামড়ার যুবকের হাতে মাইক্রোফোন দেখে বুঝলেন উনিই উপস্থাপক। তিনি জানালেন, আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ টুরিং টেস্ট হতে চলেছে। উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন একটি মেশিন আনা হয়েছে বাজারে। আর হ্যাঁ, টুরিং টেস্ট বলতে বোঝায়, মেশিনটির সঙ্গে মানুষের বুদ্ধিমত্তার মাত্রা কতটুকু তার একটি পরীক্ষা।
তো যাইহোক, আপনি উন্নত প্রযুক্তির নতুন একটি মেশিনকে দেখার জন্য বেশ উদগ্রীব। উপস্থাপক তার ব্লেজারের বোতাম লাগাতে গিয়ে মাইক্রোফোন হাত থেকে ফেলে দিলেন। খানিকটা হাসি দিয়ে পরিস্থিতিও সামলে নিলেন। তারপর একে একে এই মেশিন বানানোর পুরো প্রযুক্তি ব্যাখ্যা করলেন। আপনিও মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছেন। অবচেতন মনে খানিকটা তারিফও করলেন উপস্থাপকের দারুণ প্রস্তুতি দেখে। তার কথাও এত সুন্দর ও স্পষ্ট যে আপনি তার চোখের পাতা থেকে চোখ সড়াতে পারছেন না। হুট করে কিছু একটা ঘটলো। থেমে গেলেন উপস্থাপক। আক্ষরিক অর্থেই থেমে গেলেন। মনে হলো, মাদাম তুসো মিউজিয়ামের মোমের এক মূর্তি। কিছুক্ষণ আগেই দারুণ ভাবে কথা বলতে থাকা জলজ্যান্ত উপস্থাপক এভাবে মূর্তি বনে গেলেন কী করে! ঠিক তখনই অদৃশ্য একজন বলে উঠলো,
‘আমাদের তৈরি করা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নতুন মেশিনটির উপস্থাপনা এতক্ষণ আপনারা দেখছিলেন’। ভাবুন, আপনি কি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারবেন?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ইংরেজিতে বলা হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। আবিষ্কার হবার পর আপনার মতই অনেকে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি। এই প্রযুক্তির যত উন্নয়ন ঘটছে, বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়া বিষয় ততই বাড়ছে। প্রথম দিকে এসব প্রযুক্তি প্রচন্ড ব্যয়বহুল হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবার জন্য এটি সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে। গুগল এসিস্ট্যান্ট তো সবার জন্য ফ্রিতেই সুবিধা দিচ্ছে। গুগল ছাড়াও অ্যালেক্সা বা অ্যাপলের সিরি সবার মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) নিয়ে বিজ্ঞানী, টেকনোক্র্যাটদের উন্নতর গবেষণা এবং সাফল্য সেই প্রযুক্তিকে আমাদের বর্তমান জীবনের সঙ্গে এক সারিতে জুড়ে দিয়েছে। বিশেষ করে আজকের ইন্টারনেট-টেলিফোনির যুগে। ইন্টারনেট প্রজন্মের (থ্রি-জি, ফোর-জি, ফাইভ-জি) উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সেই এআই নির্ভর প্রযুক্তির ব্যবহার ও কার্যকারিতা বেড়ে চলেছে। সে ইন্টারনেট সার্চ থেকে মোবাইলে অ্যালার্ম দেয়াই হোক, বা টেক্সট ট্রান্সলেট (এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদ) থেকে সংবাদ পরিবেশন এবং সর্বোপরি রাস্তার সিগন্যালে ট্র্যাফিক পরিষেবা বা সীমান্তে পাহাড়া।

কিন্তু এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি কোনভাবে আমাদের মানব অস্তিত্বের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে?
প্রশ্নটা বেশ জটিল। পৃথিবীর কোটি কোটি বছরের ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখি শক্তিশালী সব প্রাণীদের পরিবেশের জন্য টিকে থাকার লড়াই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে এমন সব প্রাণী, যা হয়তো সেসময়টায় ভাবাই যেত না। এই দিক থেকে দেখলে খানিকটা দ্বিধা দ্বন্দ্ব তো চলেই আসে। তবে কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে হেরে গিয়ে একদিন অস্তিত্ব সংকটে পরবে মানুষ?
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্ষমতা বা প্রয়োগকে খানিকটা ঘাটলে আমরা এর বেশ কিছু ধরন দেখতে পাই। মোটাদাগে একে চারটি ভিন্ন ধরণে পাওয়া যায়। যেমন:
১. Reactive Machine
এটিকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের একদম মৌলিক ধাপ বলা যেতে পারে। এদের মুলত কোন স্মৃতি জমা থাকে না। এরা আপনাকে পরবর্তী কাজে সাহায্য করলেও পূর্বের ডেটা ঘেটে পরবর্তীতে কী হতে পারে সেই হিসেব করে না। কারণ পূর্বের কোন স্মৃতি বা মেমোরি তার নেই।
২. Limited Theory
এই ধাপে খানিকটা স্মৃতি থাকলেও তা বেশ দুর্বল ও অস্থায়ী মেমোরি। এরা কাজ করার সময় আগের স্মৃতিকে কিছুটা কাজে লাগাতে পারে। চালকবিহীন গাড়ি এই ধাপের একটি ভালো উদাহরণ।
৩. Theory of Mind
আমরা এই থিওরি পর্যন্ত এখনও পৌছতে পারিনি। থিওরি অব মাইন্ড বলতে সহজে বোঝায়, এই মেশিনগুলোর থাকবে নিজস্ব এক সত্তা। মানুষের মতই এদের বেশ কিছু আনন্দ-বেদনার প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা থাকতে পারে। একদম শুরুতে যেভাবে একটি টুরিং টেস্টের উদাহরণ পেয়েছিলাম, সেরকম ঘটতে পারে এই ধাপে এসে।
৪. Self awareness
এটি মূলত theory of mind এর বর্ধিত রূপ। এই ধরনের মেশিনগুলো কেউ একজন কি বলতে চাইছে বা কি করতে চাচ্ছে, তা বুঝতে পারবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে পারবে। বলা চলে আদর্শ এক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের রূপ এটিই।
শেষ দু’টো ধরণ নিয়ে খানিকটা এরকম প্রশ্ন চলে আসতে পারে, মানব অস্তিত্ব ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে কিনা। সত্যি বলতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা এটাই করা হয়ে আসছে, এই যন্ত্র গুলো এতোটাই দক্ষ হয়ে উঠছে যে, হয়তো দুর্ঘটনাবশত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে তাদেরকে কোনো ভুল কাজে নিয়োগের মাধ্যমেই আমাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে। এই হুমকির কথা চিন্তা করে বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে গবেষণা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবসময়ই একটু বেশিই সচেতনতা অবলম্বন করার কথা বলে আসছেন।
কিন্তু এখানে অস্ত্বিত্বের হুমকি বলতে আসলে আমরা কী ভাবছি সেটাও একটি বড় প্রশ্ন। বিভিন্ন সাই ফাই সিনেমা কিংবা বইতে মানুষের অস্তিত্ব যেভাবে বিলীন করে দেয়া হয়, এভাবে কি আমরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কাছে হার মানবো? নাকি অন্যভাবেও কিছু ঘটতে পারে?

কবি যেমনটা বলেছিলেন, ‘এসেছে নতুন শিশু, ছেড়ে দিতে হবে স্থান’। তেমনি আমাদের আর্থ-সামাজিক জীবন তো বটেই; বরং ব্যক্তিগত জীবনেও আবির্ভূত হয়েছে এক ‘নতুন শিশু’। খেয়াল করলে দেখবেন, আমাদের চাকরি ক্ষেত্রেও ‘নতুন শিশু’ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রবেশ ঘটেছে। এতে করে চাকরির নিয়োগেও কিন্তু বেশ বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফরচুন-এ প্রকাশিত বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় অটোমেশন পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করেছে বলে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। ওই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বাংলাদেশ ভিত্তিক সংবার মাধ্যম প্রথম আলো বলছে, চাকরিপ্রত্যাশীদের সিভি থেকে বিভিন্ন শব্দ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে বের করছে রোবট! রোবট ছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং টুল ব্যবহারের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগের পদ্ধতি বিশ্বের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। যেমন, সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যক্তির চরিত্র ও বুদ্ধিমত্তা নির্ধারণপূর্বক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক নিয়োগ দেয় ডিপসেন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সানফ্রান্সিসকো ও ভারতভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটি জানাচ্ছে, তারা ব্যক্তির ফেসবুক, টুইটার, লিংকডইন ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণের কাজে ডেটা সায়েন্স ব্যবহার করে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনি কী ধরনের ছবি পোস্ট করছেন, কী লিখছেন, কী ধরনের খবর শেয়ার করছেন, আপনার প্রোফাইলের ছবিটা কেমন ইত্যাদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে আপনার আচরণগত দক্ষতা নির্ণয় করা সম্ভব।

দেখুন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের এরকম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দিকের প্রভাবই দেখতে পাই। একভাবে ভাবলে, চাকরির ক্ষেত্রে লবিং সংস্কৃতি কিংবা চাকরি নিয়োগে যে দূর্নীতির সুযোগ থাকে, তা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহারের ফলে দূর করা সম্ভব। এটি যেমন ভালো একটি দিক, তেমনি নিয়োগের ক্ষেত্রে মানুষের অনুপস্থিতি অনেকের কর্মক্ষেত্রে শুধু নষ্ট করছে তা নয়; বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ বিভিন্ন কিছু বিশ্লেষণ করে একজনের ব্যক্তিগত জীবনের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আদতে এই ক্ষেত্রে মানবিক যেসব জায়গাগুলো ব্যবহারের সুযোগ ছিলো সেগুলোর পরিবর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জায়গা করে নিচ্ছে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অধিক ব্যবহার হয়তো অনেকের কর্মসংস্থান নষ্ট করতে চলেছে। এটিও মানব অস্তিত্বের জন্য একরকম হুমকিই বটে। সাধারণত একটি রোবট প্রায় দশ জন মানুষের সমান কাজ করতে পারে। সে হিসেবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে একটি রোবটই দশজন মানুষের চাকরি হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়াও আগামী দিনগুলোতে চিকিৎসাসেবায়, অফিস-আদালতে, শিল্প-কারখানায়, সংবাদসংস্থা বা গণমাধ্যমে, টেলিফোন সেবায়, বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, হোটেল-রেস্তোরা এমনকি বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র তথা রোবটের ব্যাপক ব্যবহারের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে বিপুল পরিমান মানুষ বেকার হওয়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। যা সামগ্রিক ভাবে মানব অস্তিত্বের জন্য একটি বড় হুমকি।
আবার অপরদিকে, ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ বলছে, ২০২২ সালের মধ্যে রোবটের কারণে বিশ্বজুড়ে সাড়ে ৭ কোটি লোক চাকরি হারাতে পারে। তবে এ নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সংস্থাটি বলেছে, একই সময়ে নতুন প্রযুক্তির কারণে ১৩ কোটিরও বেশি কাজের সুযোগের সৃষ্টি হবে। ডাটা এনালিস্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপার, সোশ্যাল মিডিয়া স্পেশালিস্ট এ ধরনের কাজ অনেক বাড়বে। সুতরাং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুক্ততার কারণে এই ক্ষেত্রে আশীর্বাদই বলা যায়।
তাই পুরো আলোচনার উপসংহার টানলে আমরা দেখি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলেজেন্সের সঠিক ও পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার মানব জাতির জন্য অস্তিত্ব হুমকি নয়; বরং হতে পারে আশীর্বাদস্বরূপ। তাছাড়া হলিউডের সিনেমাগুলোতে যেভাবে রোবটদের দ্বারা মানুষের অস্তিত্ব বিলীন দেখানো হয় সেটিও খানিকটা হাস্যকর। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘Human compatible: Artificial Intelligence and the problem of control’ নামক বইয়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টুর্ট বলেন, ‘হলিউডের সিনেমাগুলোতে দেখানো হয় যে, যন্ত্রগুলো নিজে থেকেই সচেতন হয়ে উঠছে এবং তারপরে তারা মানুষকে ঘৃণা করতে শুরু করে, সবাইকে মেরে ফেলতে চায়, নগর সভ্যতা ধ্বংস করে দিতে চায়। কিন্তু রোবটের কোন মানবিক অনুভূতি থাকে না। সুতরাং সেটা একেবারেই অহেতুক একটা বিষয়, যা নিয়ে উদ্বেগের কোন কারণ নেই।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স সম্পর্কে আরও জানতে ক্লিক করুন