(১)
২০শে এপ্রিল, ১৯৭১
রাঙামাটির নানিয়ারচরের বুড়িঘাটে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে অবস্থান করছে মুক্তিবাহিনী। ব্যূহ তৈরি করে পাহাড়া দিচ্ছিলেন তারা রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথ! এই দলেরই এলএমজিম্যান মুন্সী আব্দুর রউফ।
আনুমানিক বেলা তিনটায় কাপ্তাই হ্রদের বুক চিরে আচমকা উদয় হয় হানাদার বাহিনীর স্পীডবোট ও লঞ্চ! শুরু হলো প্রচণ্ড গোলাগুলি ও যুদ্ধ! অন্য যোদ্ধাদের পাশাপাশি চলতে লাগলো মুন্সী আব্দুর রউফের লাইট মেশিনগান! ডুবিয়ে দিলেন শত্রুসেনার একাধিক জলযান! নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে এবার মর্টার শেল ছুঁড়তে থাকলো পাকবাহিনী। তাদের সাথে একাই লড়তে লড়তে মৃত্যুবরণ করলেন এই অদম্য সাহসী বীর। বাঁচিয়ে দিলেন দলনেতাসহ প্রায় ১৫০ সহযোদ্ধার প্রাণ! বাংলার ইতিহাস আত্মত্যাগের সাক্ষী হলো আরো এক দেশপ্রেমিক নক্ষত্রের, গর্বভরে স্মরিত সে নাম- বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ!

(২)
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন মুন্সী আব্দুর রউফ। নিয়োজিত ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এর ১১ নং উইং এ। ২৫শে মার্চে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচারে চালানো গণহত্যার পরপরই রুখে দাঁড়ান সেখানে কর্মরত বাঙালিরা। দূরদর্শিতা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের দরুণ তারা সাথে সাথেই রুখে দাঁড়ান ও বিদ্রোহে যোগ দেন। পরবর্তীতে ষোলশহরে গিয়ে যোগ দেন ৮ নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। পাকিস্তানিরা কালুরঘাট দখল করে ফেললে পিছু হটে রাঙামাটিতে আসতে বাধ্য হলেন ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান। মুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হলো ভারত সীমান্তবর্তী রামগড়ে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টার হিসেবে নির্ধারিত হলো মহালছড়ি। চট্টগ্রাম দখলের পর বর্ধিত মনোরথে পাকসেনারা তখন এগিয়ে চলেছে অন্যান্য জেলার দিকে। দৃপ্ত মনোবলে পাল্টা জবাব দিতে ইচ্ছুক মুক্তিবাহিনী তখনো প্রশিক্ষিত পাকবাহিনীর সাথে লড়বার জন্য তেমন প্রস্তুত নয়! প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, গোলাবারুদ ও অস্ত্রাদির। ভারতের থেকে সহায়তা পাবার কথা থাকলেও তখনো কিছুই নির্দিষ্টভাবে গুছিয়ে ওঠা হয়নি।

এদিকে পাকসেনারা দ্রুতই চাইলো রামগড়, মহালছড়ি ও মানিকছড়ির দখল নিতে। এতে একদিকে যেমন বন্ধ করা যাবে সীমান্ত পারাপার, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী পারবে না সেখানে গড়তে কোনো মুক্তাঞ্চল। যথাসম্ভব প্রতিরোধযুদ্ধে সচেষ্ট মুক্তিবাহিনী চাপের মুখে পিছু হটার জন্য নিরাপদ রাখতে চাইছিল মানিকছড়ি-মহালছড়ি-রামগড় অধ্যুষিত সড়ক ও কাপ্তাই হ্রদের জলপথ। কাজেই ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি অবস্থান নেয় কাপ্তাই হ্রদ-তীরবর্তী বুড়িঘাটে।
৩)
৮ নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর এর জনবল মিলিয়ে মোট ১৫০ জনকে দেয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথে নিরাপত্তাব্যূহ তৈরির দায়িত্ব। বুড়িঘাটের দুটি চিংড়ি খালের পাশেই ছিল তাদের ক্যাম্প। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। ৮ নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ক্যাম্প করেছিল রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথের দু’পাশেই। তাদের কাজ ছিল পাক-আর্মির গতিবিধির ওপর নজরদারী। কিছুদিনের মধ্যেই পাক-আর্মি স্কোয়াডে আক্রমণ করতে যাচ্ছিল মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা। এই দলেরই এলএমজিম্যান হিসেবে নানিয়ারচরের বাকছড়ির একটি বাঙ্কারে ছিলেন মুন্সী আব্দুর রউফ। কিন্তু পূর্বেই তাদের অবস্থান সনাক্ত করে ফেলে শত্রুসেনারা! ভারী প্রস্তুতিসমেত ৭টি স্পীডবোট ও একাধিক লঞ্চ নিয়ে তারা এগিয়ে আসে কাপ্তাই হ্রদের জলপথ ধরে! উদ্দেশ্য এই জলপথ মুক্তিবাহিনীর প্রহরামুক্ত করা।

২০শে এপ্রিলের বিকেলে পাকবাহিনীর ২ নং কমান্ডো ব্যাটালিয়নের দুই কোম্পানি সেনা মৃত্যুদূতের ন্যায় এগিয়ে আসতে থাকে মুক্তিবাহিনীর দিকে। মুহূর্তেই অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু হয়। পাশাপাশি ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা ও মেশিনগানের বুলেট ধেয়ে আসতে থাকে তাদের লঞ্চগুলো থেকে শত্রুবাহিনীর লঞ্চগুলোতে ছিল মোট ছয়টি ৩ ইঞ্চি মর্টার ছোঁড়ার কামান ও ভারী মেশিনগান। মুক্তিসেনারাও কালক্ষেপণ না করে দিতে শুরু করলেন এর পাল্টা জবাব! তবে এই প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অস্ত্রশস্ত্র ও লোকবল দুই-ই কম। শত্রুসেনার ভারী আক্রমণের সামনে তা বেশ দুর্বলই বটে। লড়াইয়ের কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়েই লড়ে গেলেন মুক্তিসেনারা। সেই সাথে চলতে লাগলো মুন্সী আব্দুর রউফের লাইট মেশিনগান। মেশিনগানের গুলিতে ডুবে গেল একে একে দুটি হানাদারবাহী স্পীডবোট, পশলার পর পশলা বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেল আরোহীরা। মুক্তিসেনারাও ততক্ষণে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে বেশ গোছালোভাবে শুরু করেছেন পাল্টা ফায়ারিং! মোট ২টি বোটের পর একটি লঞ্চ ডুবে যেতেই পাকিস্তানিদের টনক নড়লো। নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে তারা শুরু করলো মর্টার গোলাবর্ষণ, সঙ্গে দূরপাল্লার ভারী মেশিনগানের গুলি।
(৪)
বাকী লঞ্চগুলো থেকে করা প্রচণ্ড বুলেটবৃষ্টি ও বিস্ফোরণে মুক্তিসেনারা টালমাটাল হয়ে পড়লেন। শত্রুপক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নিশানা করে হামলা করলে অচিরেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেন তারা। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে অনেকেই অস্ত্রসমেত ঝাঁপ দিলেন পানিতে। বাড়তে লাগলো হতাহতের পরিমাণ। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান স্পষ্ট বুঝলেন এভাবে স্মল আর্মস নিয়ে এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়া স্রেফ আত্মহত্যারই নামান্তর। এদিকে নিশ্চয়তা নেই রিইনফোর্সমেন্ট আসারও। তাই বাঁচতে হলে পিছু হটতে হবে, যার জন্য চাই নিরবচ্ছিন্ন কাভারিং ফায়ার! মুক্তিবাহিনীর দলপতির ন্যায় পাকসেনাদের কমান্ডারও দ্রুত পরিস্থিতি আঁচ করে ফেললো এবং আচমকা অগ্রসরমান হলো মুক্তিফৌজের পিছু ধাওয়া করতে। পলায়নপর মুক্তিযোদ্ধা ও আগুয়ান শত্রুসেনার মাঝে দুর্ভেদ্য দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন মুন্সী আব্দুর রউফ।

তিনি খালেকুজ্জামানকে বললেন, ‘স্যার, আমি কাভারিং ফায়ারে শত্রুদের ব্যস্ত রাখব, আপনি কোম্পানিসহ পিছু হটে যান।’ যতক্ষণ গুলি না ফুরোয় প্রতিরোধ করে যাবেন বলেও আশ্বাস দেন তিনি। তার মেশিনগান থেকে বৃষ্টির বেগে চলতে লাগলো প্রচণ্ড গুলির ফোয়ারা! তার ক্ষিপ্রতা ও প্রচণ্ডতায় থমকে গেলো পাকসেনারা। পুনরায় পিছু হটে রউফের লাইট মেশিনগান রেঞ্জের বাইরে নিরাপদে সরে গেল তারা। রউফের মেশিনগানকে নিষ্ক্রিয় করতে লঞ্চ থেকে এবার তার ট্রেঞ্চ বরাবর শুরু হলো মর্টার হামলা। শত্রুসেনার নিক্ষেপিত মর্টারবৃষ্টির সাথে আর একা পেরে উঠলেন না তিনি। ট্রেঞ্চের মেঝেতে হামলে পড়া মর্টার গোলা ডেকে আনে এই মহান বীরের মৃত্যু। ধীরে ধীরে ধরণীর বুকে লুটিয়ে প্রাণত্যাগ করেন এক লড়াকু যোদ্ধা, যার সঙ্গী হয় প্রায় দেড়শো সহযোদ্ধার প্রাণ বাঁচানোর গভীর আত্মতৃপ্তি!

(৫)
১৯৪৩ সালের ৮ই মে মুন্সী আব্দুর রউফ জন্মগ্রহণ করেন ফরিদপুরের বোয়ালমারী (বর্তমানে মধুখালী) থানার সালামতপুর গ্রামে। তার পিতা মুন্সী মেহেদি হাসান, মাতা মকিদুন্নেসা। দুই বোন জোহরা ও হাজেরা। পিতা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। তিন ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ রউফের পারিবারিক ডাকনাম ছিল ‘রব’। তার চাচা ছিলেন ইপিআরে কর্মরত একজন হাবিলদার। তার কাছে সৈনিকদের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের কথা শুনে আগ্রহবোধ করতেন রউফ।

১৯৫৫ সালে স্থানীয় আড়পাড়া হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে তার পিতা পরলোকগমন করেন। পিতার মৃত্যুর পর অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় তার পড়াশোনা। মা সংসার চালাতে থাকেন কাঁথা সেলাই ও শিকে তৈরির কাজ করে। অভাব অনটনের সংসারে সচ্ছলতা আনতে ১৯৬৩ সালের ৮ই মে ইপিআরে যোগদান করেন রউফ। চুয়াডাঙ্গা ইপিআর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষ করে পাড়ি জমান পশ্চিম পাকিস্তানে। ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষে সেখান থেকে ফিরে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে। যোগ দেন নতুন কর্মস্থল কুমিল্লায়। ’৭১ এর ২৫শে মার্চের আগে কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রামের ১১ নং উইং এ। মৃত্যুর পর দয়াল কৃষ্ণ চাকমা নামক স্থানীয় ব্যক্তি তার লাশ উদ্ধার করে নানিয়ারচরের চিংড়ি খালসংলগ্ন একটি টিলার ওপরে সমাহিত করেন। ছোটবোনের বিয়েতে শাড়ি নিয়ে আসার কথা থাকলেও আর ঘরে ফেরা হয় না তার……
জেলা ও সেক্টর-ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইসমুহ
(৬)
মুন্সী আব্দুর রউফের শেষ নিদ্রাস্থল খুঁজে পেতে এই দেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও ২৫ বছর! ১৯৯৬ সালের ২৫শে এপ্রিল তার সহযোদ্ধা ও স্থানীয়দের সহায়তায় তার সমাধিস্থল সনাক্ত করা হয়। ২০০৬ সালের ২৫শে মার্চ রাইফেলের ভাস্কর্য সম্বলিত সমাধিসৌধ নির্মিত হয় সেখানে। সহযোদ্ধাদের রক্ষার্থে ও দেশের তরে অকাতরে প্রাণ দেয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও সম্মানার্থে দেয়া হয় মরণোত্তর পদোন্নতি, ল্যান্স নায়েক পদে। তার গ্রামের নাম করা হয় রউফনগর, ২০০৪ সালে পিলখানাস্থ বাংলাদেশ রাইফেলস কলেজের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ কলেজ। এছাড়াও তার নামে ফরিদপুরে একটি কলেজ, মানিকছড়ি ও খাগড়াছড়িতে একটি করে স্কুল ও সিলেটে একটি স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়।

(৭)
বাংলাদেশের জন্ম অগণিত মানুষের অশ্রু, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে। দেশমাতার টানে বারংবার প্রদীপ্ত নক্ষত্রের ন্যায় জ্বলে উঠেছেন জাতির সূর্যসন্তানেরা! মহিমান্বিত সেই তারকারাজির একটি জ্বলজ্বলে নাম- বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ! তাদের বীরগাঁথা ও আত্মত্যাগ কখনোই ভুলবার নয়।এ জাতি ঋণী তোমাদের কাছে……
মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা বিষয়ক বইসমুহ
তথ্যসূত্র:
https://roar.media/bangla/main/liberation-war/the-valiant-defender-munshi-abdur-rouf/
http://itibritto.com/birshreshtha-munshi-abdur-rouf/
https://www.prothomalo.com/amp/life-style/article/1274646/
http://bangladeshcontinual.blogspot.com/2011/07/bir-sreshtho-munshi-abdur-rouf-battle.html?m=1
https://biographybd.com/munshi-abdur-rouf/
http://bn.banglapedia.org/index.php?
https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/elius/29297821
comments (0)