সফলতা প্রতিটি মানুষের জীবনেই এক পরম আরাধ্য বস্তু, তা সে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী বা কর্মজীবী কোনো ব্যক্তির জন্যই হোক। এক্ষেত্রে যারা আমাদের অগ্রজ, অতীত ও বর্তমানের সেসব সফল ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। এ পৃথিবীতে তারা নিজ নিজ প্রতিভাবলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন এবং তাদের জীবনযাপন ও আদর্শের অনেককিছুই নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অনুকরণীয়।
শুধু পরিশ্রম কিংবা বুদ্ধিমত্তার জোরেই নয়, জীবনযাপনের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও অভ্যাস মেনে চলার জন্যই একটা পর্যায়ে সফলতা ধরা দিয়েছে তাদের কাছে এসে। এর মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস একটি অন্যতম বিষয়।
আজকের এই লেখায় আমরা এমন কিছু সফল ব্যক্তির কথা বলব, যারা তাদের সফলতার অনেকটা কৃতিত্বই নিজেদের বই পড়ার স্বভাবকে দিয়েছেন। অনেক ভালো বই থেকে আমরা এটাও জানতে পারি যে, জ্ঞানের অভাবের কারণেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যায়। নিজেদের ভেতরে যদি কোনো অভাব অনুভব করে থাকেন, তা সে আত্মিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বা সম্পর্কজনিত যা-ই হোক না কেন, সেই অভাব পূরণের জন্য ভালো কোনো বই আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করবে। যেকোনো শেয়ারমার্কেটের চেয়েও নিজের মনের মধ্যে বিনিয়োগ করাটা বেশি লাভজনক। সামাজিক মাধ্যমের ইন্দ্রিয়ভোগ-লালসায় অনুরক্ত না হয়ে আপনি ভালো বইয়ের কাছে যেকোনো সঙ্কটের মুহূর্তে অবলীলায় আশ্রয় নিতে পারেন। বই আপনাকে ফিরিয়ে দেবে না।
“লিডার্স আর রিডার্স”
অনেকেই কথাটি শুনে থাকবেন. এটি যে সত্যি, তারই প্রমাণ নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল এই ব্যক্তিরা। চলচ্চিত্র পরিচালক উইল স্মিথ বইয়ের মধ্যে পৃথিবীর যেকোনো সমস্যার সমাধান লুকিয়ে আছে বলেই বিশ্বাস করেন। তাঁর মতে, পৃথিবীতে কোনো নতুন সমস্যার উদ্ভব হয় না। আমাদের কারো পক্ষেই নতুন কোনো সমস্যার মুখোমুখি হওয়া সম্ভব নয়, কেননা কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ, কখনো না কখনো সেই সমস্যার সমাধান একটি বইয়ে লিখে দিয়ে গেছেন।

যারা সফল তারা আসলে কতটুকু পড়ুয়া?
বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কর্তা টমাস আলভা এডিসন আমাদের জানাচ্ছেন, বই কীভাবে তাঁর নতুন নতুন আবিষ্কারে সাহায্য করে। তিনি যখন কোনো আবিষ্কারের নেশায় মত্ত হতেন, তখন সেই বিষয়ে লেখা যতগুলো সম্ভব বই পড়ে নিতেন। তিনি মনে করতেন, আবিষ্কারে সাহায্য করবার জন্যই লাইব্রেরিগুলো বইয়ে ভরা!
এমনকি আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা ও অন্যতম জনক এবং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনও ছোটবেলা থেকেই বইপোকা ছিলেন। হাতখরচের সবটা টাকা তিনি বই কিনেই ব্যয় করতেন। এ নিয়ে তাঁর কখনোই কোনো আফসোস ছিল না, বরং তিনি গর্ব করেই বলতেন একথা। তার লেখা কিন্তু বইও আছে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের আত্মজীবনী পড়ুন

ইতিহাসের পাতায় ভাস্বর হয়ে থাকা বিপ্লবীরাও বইয়ের মধ্যেই ঘর খুঁজে পান। কিউবার মহান বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাঁর কারাবাসের দিনগুলো নিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলেন, কারণ ঐ সময়টাতেই তিনি জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় পেয়েছিলেন বই পড়ার জন্য। তিনি তখন দিনে পনেরো ঘণ্টা কাজে লাগাতেন শুধু বই পড়ার জন্যই।
দেখুনঃ যে ৯ টি বই উদ্যোক্তাদের অবশ্যই পড়া উচিত
বিখ্যাত সাহিত্যিক ফ্রেডরিক ডুগলাসের মতে,
একজন মানুষ শুধুমাত্র পড়তে জানলেই স্বাধীনতার স্বাদ পেতে পারে। কারণ, জ্ঞান কাউকে দাসত্ব মেনে নিতে দেয় না।সাহিত্যিক রিক ওয়ারেন পড়াশোনার বিষয়টাকে একটা ভারসাম্যের মধ্যে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন। বই পড়ার ক্ষেত্রে তিনি কোনো সীমাবদ্ধতা রাখা পছন্দ করেন না। তিনি মনে করেন, আমরা যাদের সাথে সহমত পোষণ করি না, তাদের পছন্দও বই পড়ার ক্ষেত্রে চেখে দেখা উচিত। নিজেকে ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমেই আমরা ভিন্ন ধরনের জ্ঞান অর্জন করতে পারি।
আমেরিকান সাহিত্যিক ও বাগ্মী অ্যান্থনি রবিনস যখন তরুণ ছিলেন, তখন তিনি ঠিক করেছিলেন প্রতিদিন একটি করে বই পড়বেন। না, সেটি তাঁর করা হয়নি। কিন্তু এই ভাবনাটির জন্যই পরবর্তী ৭ বছরে তিনি ৭০০টিরও বেশি বই পড়ে ফেলেছিলেন। আসলে লক্ষ্য যত উঁচুতে থাকবে, প্রাপ্তির পারদ সেই বিন্দু ছুঁতে না পারলেও কাছাকাছি যাবে। সেটুকুই আমাদের অর্জন, জ্ঞানের ক্ষেত্রে, সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে।

আমেরিকার একসময়ের মন্ত্রী এবং মানবাধিকার কর্মী ম্যালকম এক্সের অভিজ্ঞতাও খানিকটা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতোই। কারাবাসের সময়টাতে তিনি ব্যাপক পড়াশোনা করেন। এবং পরবর্তী সময়ে তিনি অভিজ্ঞতা বর্ণনার সময় বলেন, কারাবাসের দিনগুলোতেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, এই পড়াশোনা তাঁর জীবনের গতিপথ পাল্টে দেবে। পড়তে পারার সক্ষমতা তাঁর মধ্যকার দীর্ঘ জ্ঞানতৃষ্ণাকে জাগিয়ে দিতে পেরেছিল।
তিনি যেন মানসিকভাবে উজ্জীবিত বোধ করছিলেন বিভিন্ন ধরনের বইয়ের সঙ্গ পেয়ে। “বই মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু”- এ কথাটি তিনি তাঁর জীবনে শিরায় শিরায় অনুভব করতে পেরেছেন। তাঁর মতে, তাঁর জীবনে এমন অবসর পনেরো মিনিটও নেই, যখন তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তির পথে কিছুটা এগিয়ে দিতে পারে, এমন কোনো বই পড়ছেন না। তাঁর জীবনের লক্ষ্য অর্জনে বই-ই তাঁকে সর্বোচ্চ সাহায্য করেছে।
বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার পছন্দের তালিকায়ও বই সবসময়ই সবার শীর্ষে অবস্থান করত।

আমেরিকান রাজনীতিবিদ ডক্টর বেন কারসন ছোটবেলায় তেমন ভালো ছাত্র ছিলেন না। তবে তাঁর মা জানতেন, কী করে সন্তানদের পড়াশোনায় মনোযোগী করতে হয়। তাই বইকে তিনি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডিতে নয়, বিনোদনের মাধ্যম করে তুললেন। তিনি টেলিভিশন বন্ধ করে বাচ্চাদেরকে বই পড়ায় উৎসাহী করেছিলেন, আর সে সিদ্ধান্তের জের ধরেই তাঁর সন্তান সাফল্যের শিখরে আরোহণ করেছেন।
আমেরিকান বিজনেস ম্যাগনেট খ্যাত ওয়ারেন বাফেট মনে করেন, তিনি অধিকাংশ ব্যবসায়ীর চাইতে অনেক বেশি পড়েন এবং চিন্তা করেন, এবং তাদের চাইতে অনেক কম আবেগী সিদ্ধান্ত নেন। নিজের সাফল্যের মূলমন্ত্র হিসেবে এই নীতিতেই বিশ্বাসী তিনি। তিনি তার রোজকার ওয়ার্কিং আওয়ারের শতকরা ৮০ ভাগ সময়ই ব্যয় করেন কেবল বই পড়ে। ভাবতে পারছেন কতটা বই পড়ুয়া মানুষ। যারা ওয়ারেন বাফেট নিয়ে জানতে আগ্রহী তারা ওয়ারেন বাফেট সাকসেস সিক্রেট বইটি পড়তে পারেন।
দেখুনঃ বিশ্ববরেণ্য কোটিপতিদের জীবন পাল্টে দেওয়া ৭টি বই

আমেরিকান উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী মার্ক কিউবানের মতে, তাঁর নিজস্ব সত্ত্বা এবং তাঁর ব্যবসার গতিপথ উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে ৩০ ডলারের একটি বই তাঁকে সাহায্য করে। এবং এই ৩০ ডলার তাঁর কাছে একধরনের ভালো দামাদামি কিংবা বিনিয়োগের মতোই কার্যকর। দৈনন্দিন জীবনের রুটিনে তিনি অবশ্যই বই পড়াকে সর্বাগ্রে রাখেন, কেননা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাই একসময় বড় সাফল্য নিয়ে আসে।
‘এম্বাসি অব দ্য ব্লেসড কিংডম অব গড ফর অল ন্যাশনস’ নামক এক বিশেষ চার্চের প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর সানডে আদেলাজা তাঁর জীবনের ছয় বছর ধরে প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা করে লাইব্রেরিতে বই পড়ে কাটিয়েছেন। এ অভিজ্ঞতা তাঁকে জীবনে সাফল্যের পথে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে। আমেরিকান সাহিত্যিক ও একসময়ের বিশিষ্ট রাজনীতিক রালফ ওয়াল্ডো এমারসন মনে করেন, কোনো বিশেষ বুদ্ধিমান বা বুদ্ধিজীবী মানুষকে যদি আমরা যুক্তিতর্কে হারাতে চাই, তবে অবশ্যই তাঁর পাঠ্যতালিকাটি জেনে নেওয়া দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জীবনেও বই পড়ার তাৎপর্য অনেক বেশি। তাঁর মতে, যে ব্যক্তি বই পড়ে, তাঁর কাছে সমগ্র বিশ্বের দ্বার খুলে যায়।
বিলিয়নিয়ার শিল্পপতি ও স্ট্রাইভ মাস্যিয়ার জীবনে প্রথম বাইবেল পড়ার অভিজ্ঞতাটি ছিল এক সুন্দর বিকেলের। একবার পড়া শুরু করার পর তিনি আর থামতে পারেননি, লাগাতার তিন সপ্তাহ দিন-রাত্রি তিনি সেই বইটিতেই ডুবে ছিলেন। এবং যখন তিনি পড়া শেষ করলেন, এক অদ্ভুত তৃপ্তিতে মন ছেয়ে গিয়েছিল।
দেখুনঃ যে ৯ টি আত্মজীবনী জীবনে একবার হলেও পড়া উচিৎ

সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ-এর কাছে শিক্ষিত মানুষের সংজ্ঞাটা কোনো পিএইচডি, এমএ বা ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী নয়। তাঁর কাছে একজন শিক্ষিত মানুষ তিনিই, যিনি কখনো শেখা বন্ধ করেন না এবং আজীবন শিক্ষা লাভ করতে চান। তাঁর মতে, মাও, ক্রুশ্চেভ কিংবা স্টালিনের কখনো এসব ডিগ্রি ছিল না। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁদের মতো অগ্রজ খুব কম লোকই আছে পৃথিবীতে।
ছোটবেলায় বিল গেটস অনেক স্বপ্ন দেখতেন, বড় হবার পর সেসব স্বপ্নের অনেকটাই হয়তো পূরণও করতে পেরেছেন। তবে তাঁর বিশ্বাস, তিনি সেই স্বপ্নগুলো দেখতে পেরেছেন, কারণ তিনি অনেক বেশি বই পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই মানুষটার সুনাম আছে তিনি প্রতি সপ্তাহে একটা করে বই শেষ করেন। বছর শেষে তিনি পড়ে ফেলেন ৫০ টার মত বই। তিনি তৈরি করেছেন তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট Gates Notes. এখানে তিনি বই পড়া শেষে, তার পড়ার একটা তালিকা আর তার নিজস্ব একটা রিভিও প্রকাশ করেন। প্রতি বছর তিনি প্রকাশ করেন ওই বছরে তার পঠিত সেরা দশটা বই। এত বড় মাপের একজন বিজনেসম্যান কতটা সময় ব্যয় করেন শুধু বইয়ের পিছনেই!

ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত রাজনৈতিক ও যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের মতে, বই পড়াটাই শুধু দরকারি নয়, বইয়ের সাথে পরিচিত হওয়াটা আরো বেশি তাৎপর্যের। অনেক সময় অনেক বই-ই হয়তো আমাদের পড়া হয়ে ওঠে না, তবে তিনি পরামর্শ দেন সেই না পড়া বইগুলোর সাথেও একধরনের বন্ধুত্ব স্থাপন করতে, নিজের হাতে সেগুলোকে শেলফে গুছিয়ে রাখতে- যাতে অন্তত জানা থাকে, নিজের সংগ্রহের কোন বইটি কোথায় আছে।
এই ছিল ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল কিছু ব্যক্তির বইপ্রেমের গল্প। তাই আপনিও জীবনের পথে হোঁচট খেয়ে হার না মেনে আবার উঠে দাঁড়ান। নিজেকে সময় দিন এবং সেই সময়ে বই পড়ুন। ইতিহাসের বহু স্মরণীয় ও বরণীয় ব্যক্তির সাফল্যের শুরুর ধাপটা কিন্তু ভালো একটি বই-ই ছিল।
পুরস্কারপ্রাপ্ত সকল বইয়ের তালিকা দেখুন রকমারিতে
comments (0)