সূরা ফাতিহার বিশেষত্ব নিয়ে আমি ভেবে দেখলাম, এটার সবচেয়ে বড় বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য হলো সাধারণ যে কোনো মুসলিম এটা হুবুহু মুখস্থ পারে। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই সূরা ফাতেহা একদমই পারেনা এরকম মুসলিম খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অমুসলিমরাও অনেকে পারে। কারণ কুরআন নিয়ে পড়তে গেলে সর্বপ্রথম এটাই চোখে পড়ে। তাছাড়াও যে কোন স্কুলে এখনও পিটি ক্লাসে শপথের আগে এই সূরাটি পড়ানো হয়।
সূরা ফাতেহার আরেকটা বৈশিষ্ট্য আছে। সেটি হলো এটিই প্রথম সূরা যার শুরুতে বিসমিল্লাহ আছে। পবিত্র কোরআনে মাত্র একটি সূরা বাদে প্রত্যেকটি সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া বাধ্যতামূলক। এছাড়াও ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী পুরো জীবনে বিসমিল্লাহ বাক্যটার প্রভাব ও তাৎপর্য অনেক বেশি। যদিও সূরা ফাতেহা নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম কিন্তু বিসমিল্লাহ নিয়ে কিছু লেখাটা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে না।
প্রথমত বিসমিল্লাহ কী?
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (আরবী মুল বাক্যকে বাংলায় লিখতে গিয়ে মূল উচ্চারণ বিকৃত হয়েছে)। এটি পুরো একটি বাক্য। পবিত্র কুরআনকে পবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়। এটিকে পবিত্র কোরআনের অন্য যে কোনো আয়াতের মতো মর্যাদা দেয়া আবশ্যক। তবে এটি সাধারণত দুটি সুরার মাঝখানের একটি পূর্ণ আয়াত ধরা হলেও এই বাক্যটি একটি সূরার অন্তর্ভূক্তও রয়েছে। এটি আছে সূরা নামল, অধ্যায়-২৭, আয়াত-৩০। তার মানে অপবিত্র অবস্থায় কোনোভাবেই এটিকে স্পর্শ করা যাবে না।
কিন্তু আগেই বলেছি, এটি ইসলাম ধর্মের পুরো জীবনেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো ভালো কাজ শুরুর আগে বিসমিল্লাহ বলার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া হয়। তাহলে কি সবসময় পবিত্র হয়েই বিসমিল্লাহ বলতে হয়? মোটেও না। এটা সবাই জানে। অর্থাৎ কোন ভালো কাজ বা যে কোনো কিছুর শুরুতে বিসমিল্লাহ বলার জন্য পবিত্র থাকা আবশ্যক নয়। একমাত্র বাক্য ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’, যেটি একই সাথে পবিত্র কোরআনের সাপেক্ষে স্পর্শ ও পাঠ করার জন্য পবিত্র হতে হবে, আবার দুয়া হিসেবে পড়লে পবিত্র হওয়া আবশ্যক নয়। এমন তাৎপর্যপূর্ণ বাক্য খুব সম্ভবত আর নেই।
তাত্ত্বিকভাবে বিসমিল্লাহ বাক্যটির বিশ্লেষণ
আমরা যদি তাত্ত্বিকভাবেও বিসমিল্লাহ বাক্যটিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি তবে দেখবো, এটিতে মাত্র ছয়টি শব্দ ও উনিশটি বর্ণ। শুধুমাত্র ‘বিসমিল্লাহ’ নিয়েই কথা বলা যাক। এখানে তিনটি শব্দ আছে। ‘বা’ (একটি বর্ণ), ‘ইসম’ ও ‘আল্লাহ’। যারা আরবী ভাষার ব্যকরণ নিয়ে কিছুটা ধারণা রাখেন তারা জানেন আরবীতে কিছু বর্ণকে অনেক অর্থে প্রকাশ করা যায়। ‘বা’ তার মধ্যে একটি। আরবী ভাষার ‘বা’ বর্নের একাধিক অর্থ রয়েছে। আমরা দানে দানে তিন দান ভেবে তিনটি অর্থ নিয়ে বলতে পারি।
‘বা’ এর একটি অর্থ হলো- যুক্ত বা সংযোজন করা। অর্থাৎ একটি শব্দের সাথে অন্য একটি শব্দের সংযুক্ত করে দেয়া। ‘বা’ এর দ্বিতীয় অর্থ হলো- কোনো কিছুর সাহায্য নেয়া বা সাহায্য প্রার্থনা করা। আর তৃতীয় অর্থ হলো- কোনো কিছুর মাধ্যমে সফলতা অর্জন করা।
আপনি কি অবাক হচ্ছেন না, প্রায় প্রত্যেকটা অর্থই আমরা বিসমিল্লাহ শব্দটির জন্য গ্রহণ করতে পারি? মাত্র একটি বর্ণ ‘বা’ দিয়েই!
‘বা’ বর্ণের পরে আছে একটি শব্দ ‘ইসম’। তাফসীর মাআরেফুল ক্বোরআনে বলা হয়েছে- ‘ইসম’ শব্দের ব্যাখ্যা অত্যন্ত ব্যাপক। মোটামুটিভাবে এতটুকু জেনে রাখা যথেষ্ট যে, ‘ইসম’ দিয়ে আসলে নাম বোঝায়। ‘আল্লাহ’ শব্দটি সৃষ্টিকর্তার নামসমূহের মধ্যে সবচেয়ে মহত্ত্বর নাম ও তাঁর যাবতীয় গুনাবলীর সম্মিলিত রূপ। মোটকথা, আল্লাহ এমন এক সত্তার নাম, যে সত্তা পালনকর্তার সমস্ত গুণাবলীর এক অসাধারণ প্রকাশবাচক। তিনি অদ্বিতীয় এবং নজীরবিহীন। এজন্য বিসমিল্লাহ শব্দের মধ্যে ‘বা’- এর তিনটি অর্থের সামঞ্জস্য হচ্ছে আল্লাহর নামের সাথে, তাঁর সাহায্যে এবং তাঁর নামের গুণে কিছু অর্জন করা।
বিসমিল্লাহ শব্দটি নিয়েই লিখতে গিয়ে আমি ভুলে গেছি যে আসলে আমার প্রসঙ্গ ছিলো সূরা ফাতিহা। কিন্তু কয়েক বাক্য দিয়ে বিসমিল্লাহ প্রসঙ্গ শেষ করছি। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম অর্থ হলো- ‘পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি’। যে কোনো কাজের শুরুতে আল্লাহর নাম নেয়ার ব্যাপারে স্বয়ং বলেছেন আল্লাহ নিজেই। আপনি কি জানেন পবিত্র কোরআনের নাজিলকৃত প্রথম আয়াত কোনটি? এটি আছে পবিত্র কোরআনের সূরা আলাকে, অধ্যায়-৯৬, আয়াত-১। আল্লাহ বললেন, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’।
সূরা ফাতিহা প্রসঙ্গ
সূরা ফাতিহা নিয়ে কিছু বলার আগে আমি গুগলে সার্চ করলাম। শত শত ডকুমেন্ট। কুরআনের তাফসীর খুললাম, হাজার হাজার শব্দের তাৎপর্যপূর্ণ তাফসীর। ইউটিউবে সার্চ দিলাম। অসংখ্য ভিডিও। তবে বিশ্বাস করুন, বেশিরভাগই ঘুরে ফিরে এক কথা। আর কিছু আছে যার কিছুই আমি বুঝিনি। বর্তমান কিশোরদের ভাষায়, ‘মাথার উপর দিয়ে গেছে’। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি এতসব নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নই। আমি মৌলিক কয়েকটা বিষয় বলেই এই লেখার ইতি টানবো। তার মধ্যে প্রথম আয়াতটি নিয়ে কথা বলা বাঞ্চনীয়।

আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন (আরবী মুল বাক্যকে বাংলায় লিখতে গিয়ে মুল উচ্চারণ বিকৃত হয়েছে)। অর্থ নিয়ে বলার আগে এটির তাৎপর্য নিয়েও কয়েকটা কথা বলা আবশ্যক। বিসমিল্লাহ শব্দটির মত এটিরও প্রচলন অনেক বেশি। যে কোনো কাজের পরই আমরা আল্লাহকে স্মরণ করতে এবং সাথে সাথে তাকে ধন্যবাদ দিতে এই বাক্যটি, বিশেষ করে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ শব্দটি ব্যবহার করি। কিন্তু এই ধন্যবাদ দেয়া (শুকুর করা) আর তাকে স্মরণ করা দুটোই কি এক? তার আগে তাত্ত্বিক কিছু ব্যাপার নিয়ে আমরা ভাবতে পারি।
আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন- বাক্যটি প্রথম সূরা অর্থাৎ সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াত। যার অর্থ- ‘সকল প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা’। মজার ব্যাপার হলো শুধু এই বাক্যটিই কিন্তু কুরআনের বিভিন্ন জায়গাতে আমরা বার বার দেখতে পাবো। সুরা ফাতিহায় (অধ্যায়-১, আয়াত-১) এই বাক্যের পরের আয়াতে বলা হচ্ছে- ‘যিনি নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু’। অর্থাৎ যার ব্যাপারে আপনি প্রশংসা করেছিলেন ‘আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’ বলে, তাঁর কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে পরের আয়াতে। শুধু বৈশিষ্ট্য কিন্তু নয়; বরং এগুলো তাঁর গুণাবলীও বটে।
ঠিক এই বাক্যটি আরো যেসব স্থানে আছে-
• সূরা ইউনুস, অধ্যায়-১০, আয়াত-১০
• সূরা যুমার, অধ্যায়-৩৯, আয়াত-৭৫
• সূরা মু’মিন, অধ্যায়-৪০, আয়াত-৬৫
এসব জায়গায় হুবহু (আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন) আয়াতটি রয়েছে। তবে একদম প্রথম বর্ণ ‘আ’ –এর স্থলে ‘ওয়া’ যোগ করে আয়াতটি আছে আরো ভিন্ন দুটি স্থানে।
• সূরা আনআম, অধ্যায়-৬, আয়াত-৪৫
• সূরা সাফফাত, অধ্যায়-৩৭, আয়াত-১৮২

বাহ্যিকভাবে একটি সহজ বাক্য মনে হলেও এটির তাৎপর্য কতটা বেশি তা নিয়ে আমাদের সকলের ভাবা প্রয়োজন। আমরা খুব তাত্ত্বিকভাবে এই বাক্যটি বিশ্লেষণ করবো। এসব বিশ্লেষণ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে দেয়া আছে। আমি আমার পছন্দের একটি বিশ্লেষণ দেখানোর চেষ্টা করবো। সূরা ফাতিহার পুরো অংশ নিয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। আর আমার জ্ঞানও সূরা ফাতিহার পূর্ণ আলোচনা করার মতো সুবিশাল নয়। তাই শুধুমাত্র এর প্রথম আয়াত তথা ‘আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’ নিয়ে গুটি কয়েক কথা বলা যাক। তবে তার আগে দেখা যাক, এই শব্দগুলো আর কোথায় কোথায় উল্লেখ আছে। আমরা ইতোমধ্যে দেখে ফেলেছি ছয়টি রেফারেন্স, যেগুলোতে হুবহু আয়াতটি আছে। আমরা যদি একটু প্রথম অংশ খেয়াল করি অর্থাৎ শুধু ‘আলহামদুলিল্লাহ’ শব্দটি, তাহলে দেখব উল্লেখিত জায়গা ব্যতিরেকেও বেশ অনেক জায়গায় তা উল্লেখ আছে। ‘আলহামদুলিল্লাহি’ল্লাজি’ শব্দটা উল্লেখ আছে-
• সূরা আনআম, অধ্যায়-৬, আয়াত-১
• সূরা আ’রাফ, অধ্যায়-৭, আয়াত-৪৩
• সূরা ইবরাহিম, অধ্যায়-১৬, আয়াত-৩৯
• সূরা ইসরা, অধ্যায়-১৭, আয়াত-১১১
• সূরা কাহাফ, অধ্যায়-১৮, আয়াত-১
• সূরা মু’মিনুন, অধ্যায়-২৩, আয়াত-৩৮
• সূরা নামল, অধ্যায়-২৭, আয়াত-১৫
• সূরা সাবা, অধ্যায়-৩৪, আয়াত-১
• সূরা ফাতির, অধ্যায়-৩৫, আয়াত_৩৪
• সূরা যুমার, অধ্যায়-৩৯, আয়াত-৭৪
পবিত্র কুরআনের উল্লেখিত জায়গাগুলো খুললে শব্দটি দেখবেন। যদি শুধু আলহামদুলিল্লাহ শব্দটি নিয়েও ভাবি, তবে দেখবো, উপরে উল্লেখিত ১৬টি জায়গা ছাড়াও শব্দটি উল্লেখ আছে আরো বেশ কয়েকটি জায়গায়। সেগুলোর মধ্যে আছে-
• সূরা নামল, অধ্যায়-২৭, আয়াত-৭৫
• সূরা লোকমান, অধ্যায়-৩১, আয়াত-২৫
• সূরা যুমার, অধ্যায়- ৩৯, আয়াত-২৯
• সূরা আনকাবুত, অধ্যায়-২৯, আয়াত-৬৩
• সূরা নামল, অধ্যায়-২৭, আয়াত-৯
• সূরা নামল, অধ্যায়-২৭, আয়াত-৯৩
• সূরা ফাতির, অধ্যায়-৩৫, আয়াত-১
এবার তবে আগের কথায় ফেরা যাক। আগের এত এতবার উল্লেখের রেফারেন্সগুলোর কথা না হয় ভুলে যান। ভাবুন পবিত্র কুরআনের প্রথম সূরার প্রথম আয়াতের কথা। যদিও অনেক বিজ্ঞলোক বিসমিল্লাহকেই প্রথম আয়াত হিসেবে ধরে নেয়। কিন্তু আমরা সেই তর্কে না গিয়ে প্রথম আয়াত হিসেবে ‘আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’কেই ধরে নিচ্ছি। এই বাক্যের শব্দগুলোর তাৎপর্য নিয়ে চিন্তা করতে হলে প্রথমেই ‘আলহামদুলিল্লাহ’ শব্দটি নিয়ে খেয়াল করা যাক। এখানে প্রথমে ‘আলিফ’ ও ‘লাম’ দ্বারা এটিকে একটি বিশেষ্যরূপে প্রকাশ করেছে। আরবী ভাষায় বিশেষ্যকে বলা হয় ইসম। আর ইসম বা বিশেষ্য চেনার একটি সহজ উপায় হলো কোন শব্দের শুরুতে ‘আলিফ-লাম’ যুক্ত থাকা। তাই বোঝাই যায় আলহামদুলিল্লাহ শব্দটি একটি বিশেষ্য শব্দ। একটি সহজ শব্দের বিশেষ্য বা ক্রিয়া হওয়া নিয়ে কী আসে যায়? বিশেষ্যর তাৎপর্য নিয়ে আমরা যথাসময়ে আলোচনা করবো। আপাতত আলিফ-লামে ফেরা যাক। আলিফ-লাম বিশেষ্য হওয়া ছাড়াও আরেকটি কাজ করে, সেটি হলো নির্দিষ্টরূপে প্রকাশ করে। ইংরেজিতে যেটিকে আমরা The শব্দ দ্বারা কিছুটা বুঝতে পারি। অর্থাৎ আমরা এই অংশ থেকে বুঝতে পারছি, শব্দটি একটি নির্দিষ্ট বস্তুকে কেন্দ্র করে অর্থ প্রকাশ করছে এবং সাথে সাথে শব্দটি হলো- বিশেষ্য।

পরের শব্দটি হলো হামদ। হামদের সাথে আল্লাহ শব্দ যুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে ‘হামদুলিল্লাহ’। এখন শুধু হামদ নিয়েই কথা বলা যাক। হামদ শব্দের অনুবাদ হিসেবে আমরা কী দেখি? পৃথিবীর বেশীরভাগ অনুবাদকরাই এটিকে শুধুমাত্র ‘প্রশংসা’ হিসেবেই চালিয়ে দেয়। কিন্তু আদতে এর অর্থ আরো ব্যাপক ও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আরবীতে যদি প্রশংসা বোঝাতে চান তবে যে শব্দটি ব্যবহার করতে হবে, তা হলো ‘সানাতুন’। কিন্তু যখন কেউ আল্লাহর কাছে ‘শুকুর’ করে তখনও আলহামদুলিল্লাহ বলা হয়। এই শুকুর শব্দের অর্থ কিন্তু ধন্যবাদজ্ঞাপন।
স্বাভাবিক ভাবেই সানাতুন-শুকরান তথা প্রশংসা-ধন্যবাদ এক জিনিস নয়
চলুন বিষয়টাকে আরো খোলাসা করা যাক। আমি যখন প্রথম কোন মেয়েকে দেখি তাকে খুশী করার জন্য বলি, ওয়াও! তুমি দেখতে বেশ সুন্দরী। দেখুন এটা কিন্তু আমি প্রশংসা করছি। আমি কিন্তু এরকমটা বলছিনা যে, ওয়াউ তুমি বেশ সুন্দরী এজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। সুতরাং প্রশংসা ও ধন্যবাদজ্ঞাপন কখনোই এক জিনিস না। এবং ধন্যবাদ আর প্রশংসা একসাথে নাও হতে পারে। ধরা যাক, আপনার বাবা খুবই জঘন্য কাজ করে থাকে। তাও আপনি তাকে অপমান করেননা কারণ আপনি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি আপনাকে লালন পালন করে বড় করেছেন বিধায় আপনি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করে তাকে সম্মান করেন। তবে এর মানে এই না যে আপনি তার জঘন্য কাজটার প্রশংসা করছেন।

আমরা কুরআনের একটি পরিচিত উদাহরণ ব্যবহার করতে পারি। মুসা (আল্লাহ তাকে প্রাপ্য সম্মান দিক) ছিলেন আল্লাহর একজন গুরুত্বপূর্ণ নবী। পবিত্র কুরআনে সবচেয়ে বেশিবার যে নবীর নাম এসেছে, তিনি হলেন মুসা (আ)। মুসলিম ও খ্রিস্টানরা অনেকেই খুব ভালো করে জানেন, তিনি তৎকালীন ফারাও রাজার (রামেসিস-২) পরিবারে পালিত হয়েছিলেন। সে এক বিস্ময়কর ইতিহাস! কিন্তু তিনি যখন ইসলাম ধর্মের আহবান নিয়ে ফারাও রাজার কাছে যান (যিনি কিনা নিজেই নিজেকে খোদা হিসেবে দাবী করতেন), তখন রাজা তাকে বলেন, তুমি কি আমার ঘরেই পালিত হওনি? তুমি এখন এসেছো আমার বিরুদ্ধে নতুন ধর্ম নিয়ে? তখন মুসা (আ) উত্তরে কী বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, ‘ওটা তো ছিলো আমার জন্য আপনার একটি অনুগ্রহ’। এই কথা দ্বারা মুসা (আ) কী বোঝালেন? তিনি সেই অনুগ্রহের কথা স্বীকার করলেন এবং কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। এর মানে কি তিনি ফেরাউনের প্রশংসা করলেন? মোটেও না। তাহলে খুব সহজেই ধরতে পারছি প্রশংসা না করেও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা যায়।
আমরা আলহামদুলিল্লাহের অনুবাদ কিভাবে করছি? সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। কিন্তু আমরা আগেই জানি প্রশংসার আরবী শব্দ হলো- শুকরান। তাহলে হামদ শব্দটি ব্যবহার কেন করা হলো? দেখুন আপনি যে কারো প্রশংসা করতে পারেন। আপনি আমার লেখাটা পড়ে প্রশংসা করতে পারেন। যদিও আপনি আমাকে চেনেন না। আপনি যে কোনো ভালো কাজে প্রশংসা করতে পারেন। এজন্য আপনার কিছু পাওয়ার দরকার নেই। তবে ধন্যবাদ সবাইকে আপনি দিতে পারেন না। আপনি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কাউকে বলতে পারেন না, হেই কী অবস্থা, তোমাকে ধন্যবাদ। আপনি এটা বলতে পারেন না, কারণ- ধন্যবাদ আপনি তাকেই দিতে পারেন, যার থেকে আপনি কিছু অর্জন করেছেন।
খেয়াল করুন, আপনি ‘যে কাউকে’ ধন্যবাদ দিতে পারেন। রাস্তাটা খুব ভালোভাবে তৈরি করা হয়েছে, এজন্য আপনি কখনোই রাস্তাকে ধন্যবাদ দেন না। আপনি কেবল রাস্তা তৈরির সাথে জড়িত ‘কাউকে’ ধন্যবাদ দিতে পারেন। তাহলে এখানে এমন একটি শব্দই বাছাই করা হলো যা দিয়ে একই সাথে আপনি প্রশংসা করছেন এবং ধন্যবাদজ্ঞাপন করছেন, সেটি এমন কাউকে যিনি মাধ্যম নন, বরং সকল কিছুর উপরে। আল্লাহ কতই না পবিত্র! ভাবুন, এই এক শব্দের মধ্যে কত তাৎপর্য তিনি রেখেছেন!
আরও পড়ুন-কোরআনেও কি বৈপরীত্য আছে ?
তাফসীরুল কোরআনের বইগুলো দেখুন
রকমারির সংগ্রহে থাকা সকল ইসলামি বই