১৯৬৫ সাল, এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিলো শিকার পাগল সেলস ম্যানেজার মাহবুব আমিনের সাথে। পরিচয়ের পর সখ্যতা গরে উঠতে খুব বেশীদিন সময় লাগেনি, প্রায় প্রতিদিনই আড্ডা হত দুজনার। আড্ডার ফাঁকে বন্ধু মাহবুব আমিনকে নিজের কিছু লেখা পড়তে দিলেন। লেখা পড়ে তিনি বললেন ” ভালোই হয়েছে, তবে বোঝা গেলো দুনিয়ার প্রথম সারির থ্রিলার সাহিত্য সম্পর্কে আপনার কোন ধারনাই নেই” । তারপর হাতে তুলে দিলেন “ডক্টর নো” বইটি। বইটি পড়েই প্রচলিত ধারনা ভেঙ্গে গেলো। বন্ধুর উৎসাহেই নতুন করে লেখা শুরু করলেন। গল্পের প্লটকে বাস্তবসম্মত করে সাজাতে মোটর সাইকেলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন চট্রগ্রাম, রাঙামাটি, কাপ্তাই এবং কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায়। লেখায় তৈরী করলেন নিজস্ব এক ধারা। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হলো প্রথম স্পাই থ্রিলার, যার নায়ক পেশায় একজন গোয়েন্দা। তার নাম ‘মাসুদ রানা’, যা কেড়ে নিলো অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় সকল বাঙ্গালীর মন। আর ধীরে ধীরে কাজী আনোয়ার হোসেন উঠলেন সকলের প্রিয় কাজীদা। চলুন এক ঝলকে দেখে আসি মাসুদ রানাকে।

কাজী আনোয়ার হোসেন প্রথম বই ধ্বংস পাহাড় যখন লেখেন, তখন পাকিস্তান আমল। বইটির জনপ্রিয়তা দেখে সেটা অনুবাদ হয় উর্দুতেও। নাম দেয়া হয় ‘মউত কা টিলা’। অনেকে মনে করেন মাসুদ রানা বাংলা ভাষার অন্যতম অ্যাডাল্ট সিরিজ উপন্যাস। অনেকভাবেই যৌনতা ও রোমান্স এসেছে সিরিজটিতে। কাজীদা এ নিয়ে প্রথম বই ধ্বংস পাহাড়ের ভূমিকাতেই লিখেছেন,
‘প্রথমেই বলে রাখি, এই বই বড়দের জন্য লেখা। বাংলা সাহিত্যে রহস্য উপন্যাস বলতে বোঝায় কেবল ছোট ছেলে-মেয়েদের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা এক ধরনের উদ্ভট গল্পের বই, যা হাতে দেখলে বাবা, কাকা, ভাইয়া এবং মাস্টার মশাই প্রবল তর্জন গর্জন করে কেড়ে নিয়ে নিজেরাই পড়তে লেগে যান, গোপনে। কেন পড়েন? কারণ এর মধ্যে এমন এক বিশেষ রস আছে যা প্রচলিত অর্থে যাকে আমরা সুসাহিত্য বলি তার মধ্যে সাধারণত পাওয়া যায় না। তাই ছোটদের বই থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে, আংশিক হলেও, আনন্দ লাভ করেন বড়রা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিশেষ করে ছোটদের জন্যে লেখা বলে এসব বইয়ে ছেলেমানুষির এতই ছড়াছড়ি থাকে যে আমরা বড়রা এই বই পড়ি, এবং এ থেকে আনন্দ পাই তা স্বীকার করতে লজ্জা বোধ করি। তাই ছেলেমিটাকে যতদূর সম্ভব এড়িয়ে গিয়ে বড়দের উপভোগ্য রোমাঞ্চকর রহস্যোপন্যাস রচনা করবার চেষ্টা করলাম।’
মাসুদ রানার তৃতীয় বই স্বর্ণমৃগ প্রকাশিত হওয়ার পর সচিত্র সন্ধানী পত্রিকায় তীব্র সমালোচনা বেরোয়। তাতে লেখা হয়েছিলো ‘কাজী আনোয়ার হোসেনের কলম নিয়ে হাতে আগুনের সেঁকা দেওয়া ও পল্টন ময়দানে বেঁধে জনসমক্ষে চাবুক মারা দরকার’ । এরপর বইটি সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন এতে চ্যালেঞ্জ করায় গোটা সিরিজই বন্ধ করে দেওয়ার জোগাড় করেছিলেন ক্ষুব্ধ এক সরকারি কর্মকর্তা। পরে উচ্চ আদালতের রায়ে প্রকাশিত হলে আস্তে আস্তে যৌনতা কমিয়ে দিতে থাকেন। প্রথম ১৫-১৬ বইয়ে যৌনতা থাকলেও তার পরের বইগুলিতে ছিলো নামেমাত্র। বই যৌনতার উপস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।
‘একটা পর্যায়ে আমি নিজেই উপলব্ধি করলাম, আমরা একটা ধর্মভীরু ও রক্ষণশীল সমাজে বাস করছি, যেখানে আদিরসের উপস্থিতি একটি আঘাত। যারা পড়ছে, তারা লুকিয়ে পড়ছে। তাই আমি চাটনি কমিয়ে দিলাম। অনেক পাঠক এ জন্য অভিযোগ করেছেন যে, আমি তাঁদের বঞ্চিত করছি। আমি এখনও মনে করি, রস হিসেবে রানায় যৌনতার উপস্থিতি থাকলে ভালো হতো। কিন্তু সামাজিক পরিমন্ডলটাও বিবেচনা করতে হয়। এটাও আমি জোর দিয়ে বলি যে, শুধু যৌনতা দিয়ে পাঠক টানার চেষ্টা আমি করিনি। কাহিনীর বৈচিত্র্য, অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য, রোমাঞ্চই রানাকে যুগের পর যুগ পাঠকপ্রিয়তা দিয়েছে- কাজী আনোয়ার হোসেন

মাসুদ রানার নামকরণ কিভাবে হলো?
মাসুদ রানা’র নামকরণ করা হয় দুজন বাস্তব মানুষের নামের অংশ মিলিয়ে। কাজী আনোয়ার হোসেন তাঁর স্ত্রী, আধুনিক সংগীতশিল্পী ফরিদা ইয়াসমীনের সাথে পরামর্শ করে নামটি নির্বাচন করেন। এপ্রসঙ্গে স্বয়ং কাজী আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের দুজনেরই বন্ধু স্বনামধন্য গীতিকার মাসুদ করিমের ‘মাসুদ’ আর আমার ছেলেবেলার হিরো (নায়ক) ইতিহাসে পড়া মেবারের রাজপুত রাজা রানা প্রতাপ সিংহ থেকে ‘রানা’ নিয়ে নাম হলো মাসুদ রানা।
সাংকেতিক নামঃ এম আর নাইন।
প্রথম আগমনঃ এই সিরিজের প্রথম বই বের হয় ধ্বংস পাহাড় নামে ১৯৬৬ সালে।
পেশাঃ গুপ্তচর বৃত্তি। তরুণ মাসুদ রানা বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এর এজেন্ট।
সংস্থার নামঃ ‘রানা এজেন্সি’।
যে আদলে তৈরিঃ বিশ্বখ্যাত ইয়ান ফ্লেমিং-এর গোয়েন্দা সিরিজ জেমস বন্ডের ছায়া অবলম্বনে তৈরি এই সিরিজ।
বাবাঃ জাস্টিস ইমতিয়াজ চৌধুরী।
চরিত্রায়ণ
মাসুদ রানা সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর, এবং কাল্পনিক সংস্থা বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এর সদস্য, এবং তাঁর সাংকেতিক নাম MR-9। এছাড়া রানা এজেন্সি নামক একটি গোয়েন্দা সংস্থাও রানা পরিচালনা করে থাকে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে তথা ১৯৭১-এর আগের বইগুলোতে সংস্থাটির উল্লেখ থাকতো পি.সি.আই বা ‘পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’হিসেবে। সে পৃথিবী ও বন্ধু-বান্ধবদের বিভিন্ন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মিশনে নামে। এই চরিত্রের স্রষ্টা আনোয়ার হোসেন রানা সম্পর্কে বলেন, ‘সে টানে সবাইকে কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না।’
পার্শ্বচরিত্রগুলো
সহায়ক চরিত্রে প্রথমেই মেজর জেনারেল রাহাত খানের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের প্রধান। তাঁরই তত্বাবধানে রানা নিজের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এছাড়া তার কাজে সহায়তা করে থাকে সোহেল, সলিল, সোহানা, রূপা, গিলটি মিয়া প্রমুখ চরিত্রও। সাগর-সঙ্গম বইটি লিখতে গিয়ে কোনো এক বই থেকে কাছাকাছি একটা চরিত্র পেয়ে সেটাকেই কাহিনীর উপযোগী করে বসাতে গিয়ে লেখক নিজের অজান্তেই তৈরি করে ফেলেছেন গিলটি মিয়া চরিত্রটিকে। চরিত্রটির বাচনভঙ্গি তিনি তাঁর মায়ের থেকে পেয়েছেন, যিনি হুগলির মানুষ হলেও কলকাতা শহরে বড় হয়েছিলেন। তাঁরই মুখের ভাষা একটু অদলবদল করে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন গিলটি মিয়ার মুখে। সিরিজের ‘সোহেল’ চরিত্রটি খানিকটা জেমস বন্ডের বন্ধু ফিলিক্স লেইটারের আদলে গড়া। ‘সোহানা’ হলো লেখকের কল্পনার বাঙালি মেয়ে। এছাড়া মাসুদ রানার চিরশত্রুদের তালিকায় উল্লেখযোগ্য হলো বিজ্ঞানী কবীর চৌধুরী, উ সেন প্রমুখ। ‘কবীর চৌধুরী’ এসেছে সেবা প্রকাশনীর কুয়াশা সিরিজের চরিত্র থেকে।
একবার লিখলাম, কাটাকাটি করলাম; দ্বিতীয়বার লিখলাম, আবার কেটেছেঁটে পাণ্ডুলিপির বারোটা বাজিয়ে দিলাম। তারপর ফ্রেশ করে লিখলাম তৃতীয়বার এবং অসন্তুষ্টি নিয়েই ছাপার জন্য প্রেসে দিলাম। প্রুফেও এডিট করলাম মেলা। বই যখন বের হলো, তখনো আমি খুশি নই। তবে দেখলাম: আমি সন্তুষ্ট না হলে কী হবে, পাঠক লুফে নিল বইটা সাগ্রহে- মাসুদ রানার স্মৃতিচারণে কাজী আনোয়ার হোসেন
চলচ্চিত্রে মাসুদ রানা
চরিত্রটি নিয়ে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় মাসুদ রানা সিরিজের ‘বিস্মরণ’ অবলম্বনে, ১৯৭৩ সালে। আর ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। পরিচালনায় ছিলেন মাসুদ পারভেজ তথা পরবর্তীকালের জনপ্রিয় অভিনেতা সোহেল রানা। তার পরিচালিত প্রথম ছবি এটি। বিশ বছরের বেশি সময় পর পরবর্তীকালে লেজার ভিশনের ব্যানারে এই চলচ্চিত্রটি ডিভিডি আকারে বাজারে আসে। এই সিনেমায় আরো অভিনয় করেছিলেন কবরী, অলিভিয়া, ফতেহ লোহানী, খলিল প্রমুখ। কাজী আনোয়ার হোসেন এই চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৭৪ সালে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা হিসেবে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন।

টিভি নাটকে মাসুদ রানা, চরিত্রায়নে কে ছিলেন?
বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে প্রথম প্যাকেজ নাটক ‘প্রাচীর পেরিয়ে’ এর কাহিনী রচনা করা হয় কাজী আনোয়ার হোসেন রচিত মাসুদ রানা সিরিজের ‘পিশাচ দ্বীপ’ নামক বই থেকে। কাহিনীর নাট্যরূপ প্রদান করেন আতিকুল হক চৌধুরী। ১৯৯৪ সালে প্রচারিত এই নাটকটিতে মাসুদ রানার ভূমিকায় অভিনয় করেন জনপ্রিয় মডেল তারকা নোবেল আর তার বিপরীতে সোহানার ভূমিকায় অভিনয় করেন বিপাশা হায়াত। খলনায়কের ভূমিকায় ছিলেন কে. এস. ফিরোজ।
প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কত?
সেবা প্রকাশনী কর্তৃক এই সিরিজে এই পর্যন্ত মোট ৪৫০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে বইগুলিতে মোট ৩০৩টি গল্প আছে (অনেক বইয়ের দুটি, এমনকি তিনটি ভলিউম থাকায় এমনটি হয়েছে)।
মাসুদ রানাকে নিয়ে কাজীদা বলেছিলেন ‘ সে টানে সবাইকে’ সত্যিই তাই, শৈশব কিংবা কৈশোর পেড়িয়ে হয়তো আমরা বুড়িয়ে যাবোও তবুও তার টান থেকে কখনো আমাদের মুক্তি মিলবে না। মাসুদ রানা যে আমাদের সুপার হিরো।
মাসুদ রানা সিরিজের সকল বই
আরোও পড়ুনঃ
একঝলকে হুমায়ূন আহমেদের ‘হিমু’