“বহু বছর পর, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে, কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই দূর বিকেলের কথা যখন তাকে সঙ্গে নিয়ে বরফ আবিষ্কার করেছিল তার বাবা…”
“কিভাবে মানুষ বরফ আবিষ্কার করে? আর আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে ঝলসে নিতে পারে বরফের স্মৃতি? এসব জানতে হলে আমাদের ঢুকে যেতে হবে এক আবহমান হন্তারক টানেলে, যেখানে বাতাস গোল হয়ে নেচে যায়, বায়বীয় বৃত্তের কোন পরিধি থাকে না-এই জেনেও। এক নিঃসঙ্গ, শ’বছরের বুড়ো টানেল কিংবা সেসব আশ্চর্য কুহক, জিপসি হাতের জাদুতে ঝলসে ওঠে মূহুর্তে, কাক চোখের এক জলের নদী পার হয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, এক শতাব্দী থেকে অন্য নীল শতাব্দীর দিকে।
কিংবা ধরা যাক, এখন পেয়ারার মৌসুম নেই, কিন্তু পেয়ারার সুবাসে পৃথিবী ভেসে আছে, কেননা গতকাল থেকে সে হয়ে উঠেছে নির্ভার, ঈশ্বরকে বহনের ঝুঁকি তার আর নেই। অথবা, আমরা আরও বলতে পারি সেসব কলমের কথা, যারা বহন করে হেমন্তের বিস্ফোরণ, এমন সব গল্প , যা বলার জন্য কোন এক গুঁফো কথক ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন, গল্পগুলো বলবার জন্য বেঁচে থাকেন। তারপর গল্প শেষ হয় না কখনই, এই জেনে ছুটি বাজিয়ে চলে যান, আর পৃথিবীর সময়-গল্প কিংবা যাকে বলি সাহিত্য-ফাহিত্য, তারা দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়–পৃথিবী বলুক, মার্কেস-যুগ, অথবা মার্কেস পরবর্তী যুগ। “

হ্যাঁ, সাহিত্যকে মার্কেস-যুগ আর মার্কেস-পরবর্তী যুগে ভাগ করে ফেলার মতো তেমন সাহিত্যিকই মার্কেস ছিলেন বটে! সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত বিখ্যাত-অখ্যাত কত লেখকের লেখায় মার্কেস আজ পর্যন্ত নিজের সুস্পষ্ট প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন, তা বলা একটু কঠিনই। লাতিন আমেরিকান কার্নিভাল থেকে মার্কেস চড়ে বসেছিলেন পৃথিবী প্রদক্ষিণকারী নভোযানে, কিছু না লিখতে পারার যন্ত্রণা উৎরে একেবারে নোবেল পুরস্কারের মঞ্চে, এ তো চাট্টিখানি কথা নয়!
ছেলেবেলায় দাদীর কাছে শুনেছিলেন মৃত পূর্বপুরুষ আর আত্মার গল্প। আত্মারা এসে ঘরের চারদিকে চক্রাকারে নাচে, দাদীর এমন কথা ঘোরগ্রস্ত বালকের মনের কোনো এক গহীনে ঘাপটি মেরে ছিল, আর ঘোরগ্রস্ত বালক যুবক হয়ে উঠলে তার কলমের আগায় সেসব আত্মারা এসে নাচতে লাগলো শব্দ হয়ে। ‘নিঃসঙ্গতার শত বর্ষ’ উপন্যাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সেই ঘোরগ্রস্ত যুবকের অলীক কল্পনা, যা বাস্তবে চলে না, আবার বাস্তবকে পেরিয়েও যেতে পারে না। আধুনিক সাহিত্য একে বলে ‘যাদুবাস্তববাদ।’ কিন্তু মার্কেস মানেই কি শুধু যাদুবাস্তববাদ? এক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি তাঁর পূর্বসূরী কিউবান সাহিত্যিক আলেজো কার্পেন্তিয়ের কিংবা একই সময়ে গুন্টার গ্রাসের কথাও। মার্কেস সম্পর্কে স্তুতিবাক্য লিখতে গিয়ে তাই ‘যাদুবাস্তববাদ’ এর কথা বলে ক্ষান্ত দিলে বড় অবিচার করা হবে তার প্রতি! যাদুবাস্তববাদের অনবদ্য প্রয়োগ তিনি করেছেন বটে, কিন্তু যারা পড়েছেন ‘নিঃসঙ্গতার শত বর্ষ‘ কিংবা ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ (যে নামেই বলি না কেন), তারামাত্রই একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন, কী ব্যাপক আর বিস্তৃত এই উপন্যাস, কত রঙে রঙীন। একসাথে এতগুলো থিম নিয়ে, নানান স্তরে, পৃথিবীর আর কোনো সাহিত্যিক একই সাহিত্যকর্মে কাজ করেছেন কিনা, জানা নেই।

প্রায়ই কোনো কোনো সাহিত্যিক সম্পর্কে বলতে শোনা যায় সমালোচকদের, ‘এই বইয়ের পর আর কোনো বই তাঁর না লিখলেও চলবে।’ একই কথাটি ঠিক এভাবেই, মার্কেসের এই উপন্যাসের কথা আলোচনায় এলেই বলা যায়। এর আগে তাঁর ‘লিফ স্টর্ম’ কিংবা এর কাছাকাছি সময়ে রচিত অন্য উপন্যাসগুলো সমালোচকদের পাল্লায় মোটামুটি কদর পেলেও বিশ্বব্যাপী অত পরিচিতি পায়নি।
তারপর এলো সেই দিন। ১৯৬৫ সাল। গাড়ি চালিয়ে আকাপুল্কোর দিকে যাচ্ছিলেন মার্কেস। দীর্ঘ সময় না লিখতে পারার শেলে বিদ্ধ ও ভারাক্রান্ত। ড্রাইভিং করতে করতেই তিনি পেয়ে গেলেন ‘Hundred Years of Solitude’ এর প্রথম অধ্যায়ের ধারণা। ভ্রমণে ক্ষান্ত দিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন ছ’ প্যাকেট সিগারেট নিয়ে। ঘরের দরজা বন্ধ করে লিখতে শুরু করলেন ঘোরগ্রস্তের মতো। আঠারো মাস পর যখন হুঁশ ফিরলো, তখন তাঁর পরিবারের দেনা ১২০০০ ডলার। ভাগ্যিস, মার্কেসের হাতে তখন ভবিষ্যতের বেস্ট সেলিং বইয়ের ১৩০০ পৃষ্ঠার পান্ডুলিপি। স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত হওয়া বইটির প্রথম মুদ্রণ ফুরিয়ে যায় এক সপ্তাহেই। পরবর্তী তিরিশ বছরে বিক্রি হয় বিশ মিলিয়নেরও বেশি কপি এবং অনূদিত হয় তিরিশটিরও বেশি ভাষায়। এই সেই ২৩ বছর বয়েসী যুবক, যে প্রথম পান্ডুলিপিটি শেষ করে প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে হন্যে হয়ে ঘুরছিল, আর সেই ঘোরাঘুরি চলেছিল ৭ টি বছর!
১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় মার্কেসের আরেকটি সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’। এই উপন্যাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে মার্কেস দ্বিতীয়বারের মতো তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করেন।
সাহিত্যের সূত্রে মার্কেসের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় কিউবান নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে সাহিত্য বিষয়ে নানান আলাপ-আলোচনা হত।

শুধু তাই নয়, নিঃসঙ্গতার একশ বছর প্রকাশিত হওয়ার পর মার্কেসকে আমন্ত্রণ জানানো হয় কলাম্বিয়ার সরকার ও কিছু গেরিলা দলের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে।
মেক্সিকান ঔপন্যাসিক কার্লোস মেসিয়াস, কার্ভেন্তেসের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মার্কেসকে ‘স্প্যানিশ সাহিত্যের রাজা’ উপাধি দেন।
(কবি খান রুহুল রুবেলের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে ভূমিকাংশটি গৃহীত।)
আরও পড়ুন- আব্রাহাম লিংকন, দাসপ্রথার সচেতন বিরুদ্ধবাদী
মার্কেসের গল্পসমগ্র দেখতে ক্লিক করুন
মার্কেসের সকল বই দেখুন