১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির মাসের কোনো এক সকালবেলা। টেবিলে নিজের টাইপরাইটার এনে বসলেন ইয়ান ফ্লেমিং, পুরো নাম ইয়ান ল্যাংকেস্টার ফ্লেমিং। তিনি লিখতে চেয়েছিলেন এমন এক গুপ্তচরের কাহিনী, যা শেষ করে দেবে আগের সব কাহিনীকে, যাকে ঘিরে তৈরি হবে ফ্যান্টাসি। আর এই চিন্তাতেই শুরু হলো ‘জেমস বন্ড সিরিজ‘। যাকে মনে করা হয় বিশ্বের আধুনিকতম ও ভয়ঙ্করতম সিক্রেট এজেন্ট। চরিত্রটি নিয়ে সিরিজ আকারে নির্মাণ করা হয়েছে অসংখ্য উপন্যাস, চলচ্চিত্র, কমিক্স এবং ভিডিও গেমের প্রধান চরিত্রও। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত জেমস বন্ড সিরিজের প্রথম বই ক্যাসিনো রয়্যাল। এরপর ফ্লেমিং ক্রমে ক্রমে লিখে ফেললেন ১২টি উপন্যাস আর ২টি ছোট গল্প। বিশ্বজুড়ে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে জেমস বন্ড উপন্যাস সিরিজ, এর বাইরেও রয়েছে সর্বকালের সেরা ফিকশনের তালিকায়।

জেমস বন্ড নিয়োগ পেয়েছিলেন লন্ডনের সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বা এসআইএসের প্রধান গুপ্তচর হিসেবে। যদিও ১৯৯৫ সালের পর থেকে সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বা এসআইএসের নাম পরিবর্তিত হয়ে এমআই৬ নামকরণ করা হয়। জেমস বন্ডের কোড ছিলো ০০৭। ব্যতিক্রম হিসেবে রয়েছে ইউ অনলি লিভ টোয়াইস উপন্যাসটি। সেখানে তাকে অস্থায়ীভাবে ৭৭৭৭ নম্বর দেয়া হয়েছে। বন্ড নিজেকে অন্য কারো সাথে পরিচয় করেন, “বন্ড, জেমস বন্ড” হিসেবে।
জেমস বন্ডের মতোই আরও কিছু রহস্যোপন্যাস পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কগুলোতে:
১) কিশোর অ্যাডভেঞ্চার
২) অরিজিন
মার্টিনি ককটেল হিসেবে ভদকাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন জেমস বন্ড। উপন্যাসে এখন পর্যন্ত ৩১৭ বার তার মদ্যপানের কথা বলা হয়েছে। প্রতি ৭ পৃষ্ঠায় গড়ে ১ বার মদ্যপানের বিবৃতি রয়েছে। সিনেমার চিত্রায়নের শুরুর দিকগুলোতে হাতে রোলেক্স সাবমেরিনার ঘড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখা গেলেও পরবর্তীতে তাকে ওমেগা সীমাস্টার ঘড়ি পরতে দেখা যায়। পরনে ডিনার জ্যাকেট আর হাতঘড়ির সাথে সাথে আসুন আরও জেনে নিই জনপ্রিয় এই চরিত্রের নানা তথ্য-উপাত্ত।
নাম – জেমস বন্ড
পেশা – ০০৭ এজেন্ট
বয়স – চল্লিশোর্ধ্ব
উপন্যাসে উহ্য রয়েছে জেমস বন্ডের জন্মসাল
উপন্যাসে জেমস বন্ডের জন্ম তারিখ ও সালকে উহ্য রাখা হয়েছে, কেননা ফ্লেমিং তার সৃষ্ট উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে তারিখ ও ঘটনার সময়কালকে বিভিন্নভাবে ধারণ করেছেন। ফলে বন্ডের প্রকৃত জন্ম তারিখ ও সাল নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। অধিকাংশ গবেষক ও জীবনীকারের ধারণা, জেমস বন্ডের জন্ম ১৯১৭, ১৯২০, ১৯২১ অথবা ১৯২৪ সালে। অবশ্য ফ্লেমিং তার সাহিত্যকর্মে কখনও জেমসের বন্ডের জন্ম, জন্ম সাল বা জন্মস্থান নিয়ে আলোকপাত করেননি।

যেভাবে হলো জেমস বন্ডের নাম
জেমস বন্ডের নাম রাখা হয়েছে “বার্ডস অফ ওয়েস্টইন্ডিজ” বইয়ের লেখকের নামানুসারে। বইয়ের লেখকের নামও ছিল জেমস বন্ড। কিন্তু কেমন রাখতে চেয়েছিলেন তিনি? এক প্রবন্ধে জেমস বন্ডের রচয়িতা ইয়ান ফ্লেমিং লিখেছিলেন, “১৯৫৩ সালে যখন ক্যাসিনো রয়্যাল লিখি, তখন চেয়েছিলাম প্রোটাগনিস্টের নামটা বেশ ম্যাড়ম্যাড়ে হোক।”
শারীরিক গঠন
পাতলা ও চিকন শরীর। গালে তিন ইঞ্চি লম্বা কাটা দাগ। নীলাভ-ধূসর চোখ। নির্দয়-নিষ্ঠুর মুখমণ্ডল। ছোট ছাঁচের চুল যা কপালে কমা আকারে রয়েছে। কিন্তু প্রতিমূর্তি হিসেবে গার্ডেনারের উপন্যাসে এবং পরবর্তীতে’ক্যাসিনো রয়েলে’ তার চুল ধূসররূপে চিত্রিত হয়েছে। ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ উপন্যাসে বন্ডের উচ্চতা ১৮৩ সে.মি. বা ৬ ফুট এবং ওজন ৭৬ কেজি বা ১৬৭ পাউণ্ড দেখানো হয়েছে।

পরিবার
বাবা অ্যান্ড্রু বন্ড, মা মনিক ডেলাক্রইক্স বন্ড, আন্টি চার্মিয়ান বন্ড, আঙ্কেল ম্যাক্স বন্ড, স্ত্রী টেরেসা ডি ভিসেঞ্জো (বিধবা), কিসি সুজুকি, হ্যারিয়েট হর্নার এবং ছেলে জেমস সুজুকি বন্ড (কিসি সুজুকির ছেলে)।

কেমন ছিল জেমস বন্ডের শৈশব-কৈশোর?
জেমস বন্ডকে ইউ অনলি লিভ টোয়াইস চলচ্চিত্রে স্কটিশ বাবা অ্যান্ড্রু বন্ড এবং সুইস মা মনিক ডেলাক্রইক্সের সন্তান হিসেবে দেখান হয়েছে। কৈশোর থেকেই জেমস বন্ডকে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতে দেখা যায়। বাবা একটি কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন বিধায় জেমসও জার্মান এবং ফরাসি ভাষা শিখতে পেরেছিলেন। চ্যামোনিক্সের কাছাকাছি আইগুইলস্ রোগেসে পর্বতারোহণের সময় তার বাবা মারা যান। জেমস বন্ডের বয়স তখন এগার বছর। অন হার ম্যাজিস্ট্রিজ সিক্রেট সার্ভিসে বন্ডের পরিবারের মূল লক্ষ্য হিসেবে ল্যাটিন বাক্য ‘অরবিস নন সাফিসিট’ প্রয়োগ করতে দেখা যায়। ইংরেজিতে এর অর্থ ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ নট এনাফ‘। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর বন্ড চার্মিয়ান বন্ড নাম্নী চাচীর বাসায় অবস্থান করেন।
জেমস বন্ডের মতোই আরও কিছু রহস্যোপন্যাস পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কগুলোতে:
পড়াশোনা
পেট বটম নামক গ্রামের বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন তিনি। পরবর্তীতে ১২ বছর বয়সে (ইয়াং বন্ডে ১৩ বছর) এটন কলেজে সংক্ষিপ্ত সময় পড়াশোনা করেন। কিন্তু নারী সংক্রান্ত ঘটনায় তিনি চার বছর পর চলে যান। ১৬ বছর বয়সে প্যারিস ভ্রমণে আসেন। পরবর্তীতে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় ফেটেস কলেজে ভর্তি হন। পিয়ারসনের জেমস বন্ড: দি অথোরাইজড বায়োগ্রাফি এবং ফ্রম রাশিয়া, উইদ লাভ উপন্যাসে তাকে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ইউনিভার্সিটি অব জেনেভায় পড়ালেখা করতে দেখা যায়। বন্ডের শিক্ষা সম্বন্ধে ফ্লেমিং এটন এবং ইউনিভার্সিটি অব জেনেভার কথা উল্লেখ করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবন
জেমস বন্ডের যখন কোনো কাজ থাকে না বা প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান করেন না, তখন তাকে চেলসির কিংস রোডের নিজ ফ্লাটে অবস্থান করতে দেখা যায়। তার একান্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে তার চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ স্কটিশ গৃহপরিচারিকা ‘মে’ ফ্লাট দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন। জেমসের প্রতি ভীষণ আনুগত্য ও বিশ্বস্ত মে। কখনো তাকে মায়ের মতো আদর করতে দেখা যায়। ‘লিভ এন্ড লেট ডাই‘ চলচ্চিত্রে এম এবং মানিপেনি তার ফ্ল্যাট দেখতে আসলে বন্ড তার নারী সহচর সিলভিয়া ট্রেঞ্চকে ওয়ারড্রবে লুকিয়ে রাখেন! বাড়িতে তার দুটি টেলিফোন রয়েছে। একটি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য, এবং অপরটি বাড়ির সাথে প্রধান কার্যালয়ের সরাসরি যোগাযোগ রক্ষার্থে, যা গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তগুলোতে সবসময়ই বাজতে দেখা যায়।

জেমস বন্ড সিনেমার বড় পর্দায় সাড়া জাগানো সজীব পুরুষ। ইয়ান ফ্লেমিং এর চরিত্র সৃজন এতটাই নান্দনিক যে পর্দায় বন্ডকে দেখে ভেতরে তার মতো হবার ইচ্ছা জাগেনি এমন তরুণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কাল্পনিক চরিত্র কল্পলোকে মূর্ত হয়ে ওঠে। ইয়ান ফ্লেমিং এবং জেমস বন্ড ইংরেজি সাহিত্যের সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে বিশ্বসাহিত্যের আগ্রহে পরিণত হয়েছেন।
1 thought on “জেমস বন্ড: এক ভয়ঙ্করতম সিক্রেট এজেন্ট”
Pingback: 'এক্স ওয়ার্ল্ড ' পৃথিবীর অভ্যন্তরে অন্য এক পৃথিবী ! - রকমারি ব্লগ