“আপনি কি আজকের মধ্যে এই কাজটি শেষ করতে পারবেন?”
এই অনুরোধটি অনেক কর্মচারী-ই শুনতে চান না। তবে অনেকের কাছে দীর্ঘ সময়ের – “আপনি কি মনে করেন সপ্তাহের শেষের দিকে আপনি এটি করতে পারবেন?” পরিবর্তে সংক্ষিপ্ত সময়সীমা বা ডেডলাইন থাকা কোনো কাজ শেষ করাকে এবং ঐ কাজকে কম কঠিন বলে মনে হয়। অর্থাৎ, অধিকাংশক্ষেত্রে কর্মচারীরা যে কাজের জন্য লম্বা ডেডলাইন থাকে ঐ কাজকে তুলনামূলকভাবে কঠিন বলে মনে করে।
জার্নাল অফ কনজিউমার রিসার্চে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় গবেষকরা দেখিয়েছেন যে লম্বা ডেডলাইন কর্মীদের মনে কোনো কাজকে প্রকৃতপক্ষে যতটা কঠিন তার চেয়ে বেশি কঠিন বলে ধারণা তৈরী করে থাকে, যার ফলে তারা ঐ কাজের জন্য আরও রির্সোস বা সময় ব্যয় করার প্রয়োজন অনুভব করে যা অনেক ক্ষেত্রে নিষ্প্রয়োজনীয়। এর ফলে কাজটি সম্পাদনে বিলম্ব/ গড়িমসি হওয়া এবং কর্মীদের কাজটি ছেড়ে দেয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

গবেষকরা একটি স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টারে স্বেচ্ছাসেবকদের অবসর পরিকল্পনা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত জরিপে অংশগ্রহণ করার জন্য আহবান জানিয়েছিলেন। তারা অংশগ্রহণকারীদের জন্য দুটি সময়সীমা বা ডেডলাইন নির্ধারণ করেন। একটি গ্রুপকে তাদের পরিকল্পনা জমা দেয়ার জন্য ৭ দিন সময় এবং অন্য একটি গ্রুপকে ১৪ দিন সময় নির্ধারণ করে দেন। ফলাফলগুলি দেখায় যে অংশগ্রহণকারীরা যারা দীর্ঘ সময়সীমার মুখোমুখি হয়েছিল তারা জরিপে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে দীর্ঘতর প্রতিক্রিয়া লিখেছে এবং এতে আরও অধিক সময় ব্যয় করেছিল অন্য গ্রুপটি থেকে। এই গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে গ্রুপটি লম্বা ডেডলাইন পেয়েছিল তাদের মাঝে কাজটি করার সময় গড়িমসির মাত্রা এবং কাজটি ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা অধিক ছিল।

অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায়, যে কিছু করদাতারা কর দাখিলের জন্য তাদের সমপরিমাণ আয় করা ব্যক্তিদের থেকে অধিক পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছিল সময়ের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে। যদিও সময়ের দীর্ঘসূত্রিতা হয়েছিল একটি হারিয়ে যাওয়া ডাব্লু -২ ট্যাক্স ফর্মের আগমনের জন্য। এই সমীক্ষায়, যাদের ট্যাক্স ফর্মগুলি পরে এসেছিল এবং কর পূরণের জন্য কম সময় ছিল তাদের যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে। একই কাজটি করার জন্য তাদের সমআয়ের ব্যক্তিরা কর পেশাদারদের নিয়োগ দেওয়া বা কর প্রস্তুতি সফ্টওয়্যার কেনা ইত্যাদি কাজে অধিক সময় ও অর্থ ব্যয় করেছিলেন।

এই দুটি সমীক্ষা পরিচালক বা ম্যানেজারদের জন্য শিক্ষণীয় যারা নিজের জন্য বা অন্যের জন্য সময়সীমা / ডেডলাইন নির্ধারণ করেন।
প্রথমত, এটা আমাদের বহুল আলোচিত পার্কিসন ল’টা আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করে যদিও যেখানে পার্কিনসন ল’ পরামর্শ দেয় যে দীর্ঘ সময়সীমার কারণে লোকেরা সহজে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারে এবং ফলস্বরূপ ঝামেলা হ্রাস পায় কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম যে দীর্ঘ সময়সীমা বা লম্বা ডেডলাইন মাঝে মাঝে একটি কার্যের অনুভূত অসুবিধাও বৃদ্ধি করে থাকতে পারে।
দ্বিতীয়ত, পার্কিনসনের আইন কেবল সময়ের প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে, আমরা দেখেছি যে ঘটনাবলির দীর্ঘ সময়সীমা বা ডেডলাইন থাকে তা আর্থিক প্রতিশ্রুতি বৃদ্ধি করে যেমনটি আমরা দেখেছি কর দাখিলের সময়: যে ব্যক্তিরা অধিক সময় পেয়েছে তারা অধিক পরিমাণ সময়ের সাথে অধিক অর্থও ব্যয় করে থাকে। তাই, যখন কোনও কাজে একটি আর্থিক বাজেট অন্তর্ভুক্ত থাকে সেইক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ের চেয়ে সংক্ষিপ্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা ভাল।

তৃতীয়ত, উপরোক্ত বিষয়গুলো সিঙ্গেল ডেডলাইনের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় কিন্তু যখন একসাথে একের অধিক ডেডলাইন থাকে? সমীক্ষা বলে যখন একজন ব্যক্তি একসাথে অনেকগুলো ডেডলাইন থাকে তখন সাধারণত অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জরুরী এই ধরণের কাজটি সে করে থাকে। এতে করে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর ক্ষেত্রে গড়িমসিতা বা অসম্পূর্ণ থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
উদাহরুস্বরূপ, আমরা আমাদের অফিসিয়াল ই-মেইল থেকে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা নোটিফিকেশন বেশি চেক করে থাকি। আমরা আমাদের ডাক্তারের কাছে রুটিন চেক-আপ বাদ দিয়ে কোনো শপিংমলের হোলসেলের প্রোডাক্ট কিনতে চলে যায়। এই ক্ষেত্রে রুটিন চেক আপ অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলেও, যা কোনো মারাত্মক রোগ আগে থেকে শনাক্তকরণ করতে পারে, আমরা হোলসেলের প্রোডাক্টের দিকে ধাবিত হয় কারণ তার সময়সীমা বেশিক্ষণ থাকবে না। এইভাবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার ক্ষেত্রে গড়িমসিতা দেখা যায়। এইরকম ঘটে থাকে কারণ জরুরী কাজে তৎক্ষণাৎ ফল ভোগ করা যায় যা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। আমরা উপরোক্ত উদাহরণে এই বিষয়টি লক্ষ্য করেছি যেখানে হোলসেলে তাৎক্ষণিক ফল: পণ্য ক্রয়ে ছাড় যা রুটিন চেকআপে অনুপস্থিত থাকে যদিও রুটিন চেকআপ হোলসেল থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

চতুর্থত, এমন কিছু কাজ আছে যা সম্পাদনে আসলেই অধিক সময় প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে ঐ কাজের ডেডলাইন কিভাবে সেট করতে হবে? নিঃসন্দেহে কিছু কাজ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হয়ে থাকে এবং সে ক্ষেত্রে কর্মীদের প্রোডাক্টিভিটি বা সর্বোচ্চ উপযোগ পাওয়ার জন্য ম্যানেজার কর্মীদের প্রতিদিনের আউটপুটের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে। একটা জটিল কাজের সম্পাদনের লক্ষ্য যখন কর্মীরা লম্বা ডেডলাইন সামনে রেখে কাজ শুরু করবে তখন স্বাভাবিকভাবে-ই তাদের মাঝে গড়িমসিতা বা কাজটি ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। ম্যানেজার যদি ঐ লম্বা ডেডলাইনে তার কর্মীদের মাঝে প্রতিদিনের লক্ষ্য সেট করে দেন তাহলে কর্মীরা দিনশেষে তাদের কাজের ফলটা হাতে পাবে এবং ধাপে ধাপে লম্বা ডেডলাইনেও কাজটি সম্পাদন হবে কোনোরকম গড়িমসিতা ছাড়া।

পরিশেষে এই কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে কিছু ক্ষেত্রে কাজের লম্বা ডেডলাইন সংক্ষিপ্ত ডেডলাইন থেকে অধিক কার্যকর। কিন্তু, গবেষণা এটাও বলে কাজের লম্বা ডেডলাইনের সাথে গড়মসিতার সম্পর্ক খুবই শক্ত। সেইক্ষেত্রে ম্যানেজার যদি তার কর্মীদের মনোযোগ কাজটির ডেডলাইন থেকে সরিয়ে নিত্যদিনের কাজের আউটপুটের দিকে নিয়ে যান তাহলে কর্মীদের মাঝে গড়িমসিতা বা কাজ ছাড়ার প্রবণতা অনেকাংশে কমে যাবে।
আত্ম-উন্নয়ন ও মেডিটেশন বিষয়ক বইসমূহ দেখুন