মিসির আলি । হুমায়ূন আহমেদের শক্তিশালী সৃষ্টি। উপন্যাসের জনপ্রিয় রহস্যময় কাল্পনিক চরিত্র। লেখক নিজেই এই মানুষটির ভক্ত। মিসির আলির ঘটনাগুলো ঠিক গোয়েন্দা কাহিনী নয়, কিংবা ‘ক্রাইম ফিকশন’ বা ‘থ্রিলার’-এর মতো খুনি-পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়াও নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক, বিজ্ঞাননির্ভর এবং প্রচন্ড যুক্তিনির্ভর কাহিনীর বুনটে বাঁধা। অনেক ক্ষেত্রে একে রহস্যগল্প হিসেবে ধরা যায়। এই জনপ্রিয় চরিত্রটির খুঁটিনাটি জেনে আসুন-
পরিচয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মনোবিজ্ঞান’ বিভাগের খণ্ডকালীন সহযোগী অধ্যাপক। খুবই সম্মানীত ব্যক্তি।
বয়স
মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। বয়স ৪০ থেকে ৫০ এর মধ্যে।
গঠন
তাঁর মুখ লম্বাটে। লম্বাটে মুখে এলোমেলো দাড়ি, লম্বা উসখো-খুসকো কাঁচা-পাকা চুল। প্রথম দেখায় তাঁকে ভবঘুরে বলে মনে হতে পারে। কিছুটা আত্মভোলা। হাসি খুব সুন্দর। শিশুসুলভ। স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। মানুষের মন, আচরণ, স্বপ্ন এবং নানাবিধ রহস্যময় ঘটনা নিয়ে অসীম আগ্রহ রাখেন। যুক্তিনির্ভর মানুষ কিন্তু আবেগপ্রবণ।
স্বভাব ও স্বাস্থ্য
মিসির আলি একজন ধূমপায়ী। ‘ফিফটি ফাইভ’ ব্র্যান্ডের সিগারেট খান। প্রায়ই সিগারেট ছেড়ে দেবার চেষ্টা করেন। তাঁর শরীর বেশ রোগাটে আর রোগাক্রান্ত। নানারকম রোগে শরীর জর্জরিত। লিভার বা যকৃৎ প্রায় পুরোটাই অকেজোঁ প্রায়। অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে, রক্তের উপাদানে গড়বড়, হৃৎপিণ্ড ড্রপ বিট দেয়। এজন্য কঠিন এসব রোগের পাশাপাশি সাধারণ যেকোনো রোগই তাঁকে বেশ কাহিল করে ফেলে। ফলে প্রায়ই অসম্ভব রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন।
চরিত্র
মিসির আলি যুক্তিনির্ভর একজন মানুষ বলেই অনেক সাহসী। ভূতাশ্রিত স্থানেও রাত কাটাতে তিনি পিছপা হোন না, বরং এজন্য থাকেন যে, তাতে তিনি রহস্যময়তার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারবেন। তাঁর অনেকগুলো পারঙ্গমতার মধ্যে অন্যতম হলো তিনি যে কাউকে, বিশেষ করে ঠিকানাওয়ালা মানুষকে, খুব সহজে অজানা স্থানেও খুঁজে বের করতে পারেন। এজন্য তিনি টেলিফোন ডিরেক্টরি, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর, টিভি-বেতার-এর লাইসেন্স নম্বর, পুলিশ কেস রিপোর্ট, হাসপাতালের মর্গের সুরতহাল (পোস্টমোর্টেম) রিপোর্ট ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে থাকেন। তিনি প্রকৃতির বিষ্ময়ে বিষ্মিত হলেও প্রচন্ড যুক্তির বলে বিশ্বাস করেন প্রকৃতিতে রহস্য বলে কিছু নেই। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগত সারমর্ম করতে হুমায়ূন আহমেদই লিখেন: মিসির আলি হৃদয়বান, তীক্ষ্ণ শক্তির অধিকারী। কাহিনী অনুসারে তিনি অকৃতদার।
বিশ্বাস
ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে তিনি একজন নাস্তিক। এই সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘দেবী’র ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে তিনি নিজেকে নাস্তিক বলে অভিহিত করেছেন। তবে কিছু জায়গায় তাকে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী অর্থাৎ একজন আস্তিক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
জীবনযাপন
মিসির আলি মূলত নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। মোটামুটি সব উপন্যাসে তাঁকে এভাবেই রূপায়িত করা হয়। কিন্তু ‘অন্য ভুবন’ উপন্যাসে মিসির আলি বিয়ে করে ফেলেন বলে উল্লেখ আছে। পরবর্তী উপন্যাসগুলিতে আবার তাঁকে নিঃসঙ্গ একজন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এপ্রসঙ্গে লেখক নিজেই স্বীকার করেন যে, ‘এটি বড় ধরনের ভুল’ ছিল। মিসির আলির মতো চরিত্র বিবাহিত পুরুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। আর সেই ভুল শুধরে পরবর্তী উপন্যাসগুলোতে আবার মিসির আলিকে নিঃসঙ্গ হিসেবে উপস্থাপন করেন লেখক। ফলে মিসির আলি চরিত্রটি যা দাঁড়ায়: মিসির আলি ভালবাসার গভীর সমুদ্র হৃদয়ে লালন করেন, কিন্তু সেই ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দেবার মতো কাউকেই কখনও কাছে পান না।
ভালবাসার একাকীত্বে জর্জরিত মিসির আলির নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে বিভিন্ন সময় কিশোরবয়সী কাজের লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘আমি এবং আমরা’ উপন্যাসে ‘বদু’ নামের একটি, ১৫ থেকে ১৬ বছরের কাজের ছেলের উল্লেখ রয়েছে।’ দেবী’ ও ‘নিশীথিনী’ গল্পে হানিফা নামে একটা কাজের মেয়ে ছিল। এরকম কাজের লোককে মিসির আলি লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেন। আবার ‘অন্য ভূবন’ উপন্যাসে ‘রেবা’ নামের একটি কাজের মেয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুনঃ
“শুভ্র” হুমায়ূন আহমেদ এর সবচেয়ে কম আলোচিত একটি চরিত্র !