সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শিশু পার্কের যে জায়গায় এখন গাছে গাছে সবুজ কুঁড়ি উঁকি দিচ্ছে, একাত্তরে সেখানেই অঙ্কুরিত হয়ছিল আজকের বাংলাদেশের বীজ। তারিখটি ছিল ৭ মার্চ। সোয়া তিনটায় হাজির হয়েছিলেন সাদা পাঞ্জাবি আর কালো কোর্ট পরা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লাখো বাঙালির সমাবেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
রমনার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু সেদিন মাত্র ১৯ মিনিটের এ ভাষণেই সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণের কথা বলে দিয়েছিলেন। অকুতোভয় বাঙালিরা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনে। ১৬ ডিসেম্বরও পাকিস্তানি সেনারা রেসকোর্সের এ মাঠেই আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীনতার অন্যতম নির্দেশন সেই রমনার রেসকোর্স মাঠ এখন শিশু পার্ক এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত। অথচ এই প্রজন্মের অনেকেই জানেন না, এই ঐতিহাসিক স্থানটির কথা। এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক সমাবেশকেন্দ্র রমনা রেসকোর্স ময়দান ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের পর সবুজঘেরা পার্কে পরিণত করা হয়। পার্কের এক পাশে শিশুদের জন্য একটি বিনোদনকেন্দ্র শিশু পার্ক এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান গড়ে তোলা হয়। জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু যেই স্থানটিতে দাঁড়িয়ে ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন সেই স্থানটি আগের অবস্থা নেই। তা চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে এই উদ্যানকে সংরক্ষণে ইতোমধ্যে শতকোটি টাকার প্রকল্পে কাজ করছে সরকার। কিন্তু নতুন প্রজন্ম কি জানে রেসকোর্স ময়দানের ইতিহাস ?
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো)। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির অধীনে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিকে স্থান দেয়া হয়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আন্তর্জাতিক তালিকা হচ্ছে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অংশের ঘটনার সংরক্ষণ ও সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে ইউনেস্কো।

জাতীয় ইতিহাসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান স্থানীক গুরুত্বের দিক থেকে অন্য যে কোনো স্থানের চেয়ে অগ্রগণ্য। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে জিন্নাহ যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে; প্রথম ভাষার দাবীতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তৎকালীল রেসকোর্স ময়দান থেকে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনী যেখানে আত্মসমর্পণ করেছিল সেই জায়গাটিও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আমাদের জাতি রাষ্ট্র উদ্ভবের ক্ষেত্রে এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান আর নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং বঙ্গবন্ধু উপাধির মতো অবস্মরণীয় ঘটনা। এই স্থানকে ঘিরে স্বাধীনতা স্তম্ভ, জাদুঘরের মতো স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানের অবস্থা দেখে বাংলাদেশের ইতিহাসের এর অপরিসীম গুরুত্ব প্রতিভাত হচ্ছে না।
বইমেলা, শিশু পার্ক, শাহবাগ থানা, মেট্রোপলিটন পুলিশের স্থাপনার মাঝে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক গুরুত্ব কেউ উপলব্দী করতে পারছে না। সোহরাওয়ার্দী বাংলাদেশের প্রেরণার জায়গা এবং ইতিহাস সচেতনা বিবেচনা করে এর সংরক্ষণের দাবী জানান তিনি।

শাহবাগের শিশু পার্ক এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মুগল আমলে বাগ-ই-বাদশাহী নামের এই এলাকাটি এক সময় রমনা রেসকোর্স ময়দান হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার ব্রিটিশ কালেক্টর মি. ডয়েস ঢাকানগরীর উন্নয়নে কতোগুলো বিশেষ পদক্ষেপ নেন। তিনি রমনার জঙ্গল পরিস্কার করে এলাকাটি রেসকোর্স হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঠের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেন। তখন ঢাকার নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে ঘোড়দৌড় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রমনা রেসকোর্স ময়দানে তাকে এক নাগরিক সংবর্ধনায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রমনা রেসকোর্সে এক মহাসমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমপিরা প্রকাশ্যভাবে জনসভায় শপথগ্রহণ করেন যে, কোনো অবস্থাতেই এমনকি পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের চাপের মুখেও বাংলার মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা তারা করবেন না। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে পাকবাহিনী ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪ টা ৩১ মিনিটে পাক জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন। এর মাধ্যমে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয়; ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ এখানেই অনুষ্ঠিত এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী ভাষণ দেন। স্থানটিকে ঘিরে স্বাধীনতা-সংক্রান্ত যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে সেগুলো স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীশেখ হাসিনা বিজয়স্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের এখানে ‘শিখা চিরন্তনী স্থাপন করা হয়। ওই সময় এর পাশেই নতুন প্রজন্মের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য দীর্ঘ দেয়ালে পোড়া মাটির ম্যুরালে বাংলার ইতিহাস, ভূগর্ভ জাদুঘর এবং পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার স্থানে স্বাধীনতা টাওয়ার গড়ে তোলা হয়েছে।
- এম মামুন হোসেন। সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক
আরও পড়ুন- কেমন ছিল মাওলানা ভাসানী ও ন্যাপের রাজনৈতিক মতাদর্শ?
ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভিত্তিক বইগুলো দেখুন