সুকুমার রায়ের স্ত্রী সুপ্রভা রায় বেড়াতে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি। ততোদিনে সুকুমার রায় ৩৬ বছর বয়সে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। সুপ্রভা রায়ের সঙ্গে তখন টুকটুক করে হাঁটে তারই সন্তান সত্যজিৎ। ভবিষ্যতে যিনি হতে চলেছেন বাংলা সাহিত্য ও সিনেমার বিরাট ব্যক্তিত্ব। দশ বছরের বালক সত্যজিৎ শুনেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। তাই শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ নিতে নিজের নোটবুকটা বাড়িয়ে দিলেন। মনে মনে একটু ইচ্ছা ছিলো, যদি একটা কবিতা লিখে দিতো তার নোটবুকে! কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আসলে কী লিখে দিয়েছিলেন?
এর বয়ান পাওয়া যায় সত্যজিতের স্মৃতিচারণে—
“উত্তরায়ণে গিয়ে দেখা করলাম তাঁর সঙ্গে। জানালার দিকে পিঠ করে চেয়ারে বসে আছেন, সামনে টেবিলের উপর বই খাতা চিঠিপত্রের বিরাট অগোছাল স্তূপ। আমি তখন দেশ বিদেশের ডাক টিকিট জমাতে শুরু করেছি আর এখানে চোখের সামনে দেখছি রংবেরঙের টিকিট লাগানো বিদেশি চিঠির খামগুলো এখান-সেখান থেকে উঁকি মারছে। মনে মনে ভাবলাম আমার যদি বিদেশ থেকে এত চিঠি আসত তাহলে টিকিটের জন্য আর অন্যের কাছে হাত পাততে হত না। অটোগ্রাফের খাতাটা আমি এগিয়ে দিলেও, কবিতা’র ফরমাশটা এল মা’র কাছ থেকেই। আমি ছিলাম বেজায় মুখচোরা, বিশেষ করে রবিবাবুর সামনে তো বটেই। কিন্তু কই-তখন তখন তো লিখলেন না কবিতা। তাতে যে একটু নিরাশও হয়েছিলাম সেটাও মনে আছে। বললেন ‘কাল সকালে এসে নিয়ে যেয়ো’।”

অটোগ্রাফের বদলে কবিতা
পরেরদিন সকালে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে নোটবুক নিতে গিয়ে অবাক বনে যাননি সত্যজিৎ। কারণ নোটবুকে যেই কয়েক লাইন লেখা ছিলো তার মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারেনি তখন বালক সত্যজিৎ রায়। তবে এরপর আজ পর্যন্ত বাঙালীরা বহুবার এই লাইনগুলো আওড়েছে এবং এই কটা লাইনেই খুঁজে পেয়েছে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া এক কথা।
সত্যজিতের ভাষ্যে পরেরটুকু–
“গেলাম পরদিন সকালে। বুকের ভিতরে ঢিপঢিপ করছে; এত কাজের মধ্যে আমার খাতায় কবিতা লেখার কথা কি আর মনে থাকবে? বললেন, ‘লেখা হয়ে গেছে,তবে খাতাটা কোথায় রেখেছি সেটাই হল প্রশ্ন।’ মিনিট দশেক খোঁজাখুঁজি করে ছোট্ট বেগুনি খাতাটা বেরোল একরাশ বই আর আর খাতার নীচ থেকে। সেই খাতার প্রথম পাতা খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এর মানে আরেকটু বড় হলে বুঝবে।’ দেখলাম খাতার পাতায় লেখা একটা আট লাইনের কবিতা। সেটা সেইদিন থেকে প্রায় বারো বছর অবধি ছিল আমার একার জিনিষ। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সেটা পত্রিকা আর বইয়ের পাতায় ছাপা হওয়ার ফলে হয়ে গেল সকলের।”
পাঠক, আপনারা কি ধরতে পেরেছেন কোন কবিতা ছিলো সেটা? প্রচন্ড শীতে গ্রামে ছুটিতে বেড়াতে গেলে আপনার মন যখন ভরে ওঠে আনন্দে, তখন আপনার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে এই কবিতা। বিদেশ ভূইয়ে জীবনের অনেকেই নিজের দেশকে হাতড়ে বেড়ান এই কবিতায়। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অটোগ্রাফের বদলে সত্যজিতের বেগুনি খাতায় লিখে দিয়েছিলেন এই কবিতা-
বহু দিন ধরে’বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু
(৭ই পৌষ ১৩৩৬ শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”
শান্তিনিকেতন)

সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ
তিনি ভর্তি হয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অনেক পরে সত্যজিৎ যখন চলচ্চিত্রকার হিসেবে আবির্ভূত হন, তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য একে একে বেছে নেন রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাস।
পশ্চিমবঙ্গ ভিত্তিক একটি ব্লগ সাইটের বরাত দিয়ে বলা যায়, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কিছু গানও ব্যবহার করা হয়েছিলো। তার মধ্যে ‘কথাচিত্রে রবীন্দ্রনাথ’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘মণিহারা’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘ঘরে-বাইরে’,‘দেবী’, ‘কাঞ্চনজংঘা’, ‘মহানগর’, ‘অপুর সংসার’, ‘চারুলতা’, ‘কাপুরুষ’, ‘অশনি সংকেত’, ‘শাখা প্রশাখা’, ‘জন-অরণ্যে’, ‘আগন্তুক’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহৃত হয়েছে।
১৯৪৫ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের চলচ্চিত্র-রূপ লেখেন সত্যজিৎ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই মুহুর্তে ঘরে বাইরে ছবিটি বানানোর জন্য তিনি প্রস্তুত না। এজন্য তিনি আরও সময় নেবেন। এই চিত্রনাট্য তিনি মাথায় নিয়ে ঘুরেছিলেন ৪০ বছর! প্রায় চার দশক পর তিনি নতুন করে চলচ্চিত্ররূপ লিখে ছবিটি তৈরি করেন।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি কবিগুরুর তিনটি ছোটগল্প অবলম্বনে তৈরি করেন চলচ্চিত্র ‘তিন কন্যা’। একই বছর তিনি নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তথ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। ১৯৬৪ সালে তিনি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি করেন ‘চারুলতা’। বলার অপেক্ষা রাখে না, কবিগুরুর এইসব গল্প-উপন্যাস নিয়ে নির্মিত সত্যজিতের ছবিগুলো বাংলা চলচ্চিত্রের আর্কাইভে সেরা সংযোজন হয়ে আছে।

সত্যজিতের চোখে বাংলাদেশ
সময় তখন ১৯৭২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী। অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রথম মাতৃভাষা দিবস। যা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাজধানীর পুরানা পল্টনে একটি আয়োজন করে এই উপলক্ষ্যে। সেখানে সত্যজিৎ রায় একটি ভাষন দেন। সেই ভাষণটির তেমন কোন কপি নেই। তবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন তবিব নামের একজন নাট্যব্যক্তিত্ব। তিনি তার টেপ রেকর্ডারে সেই ভাষনটি রেকর্ড করেন। বিশ্বাস করুন মাইরি বলছি, যতবার আমি সেই ভাষণ আমি শুনি কোন কারণ ছাড়াই আমার গায়ে কাঁটা দেয়। বাংলা ভাষায় এত সুন্দর কথা বলতেন সত্যজিৎ?
তিনি সেখানে বলেন,
“বহুদিন থেকে শহীদ দিবসের কথা শুনে আসছি। একুশে ফেব্রুয়ারির কথা শুনে আসছি। কিন্তু এখানে এসে নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না আপনারা বাংলা ভাষাকে কতখানি ভালোবাসেন। বাংলা ভাষা যখন বিপন্ন, তাকে বাঁচানোর জন্য যে সংগ্রাম হয়েছিল, তাতে যাঁরা আত্মোৎসর্গ করেছেন, তাঁদের এবং তাঁদের স্মৃতিকে যে কতখানি শ্রদ্ধা করেন আপনারা, সেটা আমি আজকে এখানে এসে বুঝতে পারছি।”

সাহিত্য ও সিনেমার মেলবন্ধন
বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসগুলো ছবির পর্দায় জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে সত্যজিৎতের হাত ধরে। এর আগে যদিও দেবদাস উপন্যাসটি অনেক ভাষায় চলচ্চিত্রায়ন হয়েছিলো। কিন্তু সত্যজিৎ যেন একাই টেনে নিয়ে গেছেন সাহিত্য-সিনেমার সুতো। পথের পাঁচালি ছবির বিখ্যাত সেই সংলাপ- ‘এবার জ্বর ছাড়লে একদিন রেলগাড়ি দেখতে যাবি তো?’ সিনেমার পর্দায় দেখার পর অনেকের মনকেই নতুন করে আন্দোলিত করেছিলো গল্পটি। সত্যজিৎ একে একে নির্মাণ করেছেন বহু চলচ্চিত্র, যেগুলো ছিলো বাংলা সাহিত্যের দারুণ সব উপন্যাস থেকে ধার করা। মজার ব্যাপার হলো, নিজের লেখা বই থেকেও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন সত্যজিৎ। চলচ্চিত্রের গল্প বলার ভঙ্গি ধরে রাখতে পর্দায় পাল্টে দিয়েছেন নিজের লেখা বইয়ের দৃশ্য। আগেই পড়ে ফেলা গল্পও সিনেমার পর্দায় হয়ে উঠেছিলো নতুন। ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে জটায়ুর সঙ্গে ফেলুদার পরিচিত হবার দৃশ্যের সঙ্গে বইয়ের দৃশ্য একদমই মেলানো যায় না। তাও কেন যেন, একই দৃশ্যের দুটো আলাদা চিত্রকেই বড্ড ভালো লাগে। সত্যজিতের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে সন্দীপ রায় বানিয়েছেন একাধিক চলচ্চিত্র, যার বেশিরভাগই সত্যজিৎ রায়ের লেখা বইগুলো থেকে নেয়া।

এই যুগের সত্যজিৎ
বহুদিন হলো পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের চর্চা এতটুকুনও কমেনি। এই যুগের ছেলেমেয়েদের এখনই কৈশোর কাটে ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু ও তাড়িনীখুড়োর চরিত্রদেরকে নিয়ে। এখনও ভারতের বঙ্গে তৈরি হয় সত্যজিতের গল্প থেকে চলচ্চিত্র। ফেলুদা তো সিনেমার পর্দায় এসেছে বার বার। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের যুগে নতুন করে ফেলুদা এসেছে ওয়েব সিরিজ আকারে এবং সামনেও আসার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সিনেমার আলোচনা এলেই প্রাসঙ্গিক হয়ে যান সত্যজিৎ। তার বইগুলো খুললে বেরিয়ে আসে লেখার বাইরে অনন্য সব আঁকা, যাতে লুকিয়ে আছে পিতা সুকুমার রায় এবং পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়ের মিষ্টি হাসি।
বছরের পর বছর সময় চলে যাওয়ার পরও সেই যুগের তরুণ সত্যজিৎকে এই প্রজন্ম দেখতে পায় একই রকমভাবে। তারা ভাবে, সত্যজিৎ আসলে এই যুগেরই!
আরও পড়ুন-সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদানামা
সত্যজিৎ রায়ের লেখা বইগুলো দেখুন
সত্যজিৎকে নিয়ে লেখা অন্যদের বই