ফেলুদা । বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় গোয়েন্দা। কাল্পনিক এই চরিত্রটি সৃষ্টি ও চিত্রায়ন করেছেন সত্যজিৎ রায়। ফেলুদা প্রথম পাঠকের সামনে আসে ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। পশ্চিম বাংলার জনপ্রিয় পত্রিকা সন্দেশ-এর ডিসেম্বর সংখ্যায় ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ প্রকাশ হয়। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। কী বই, কী চলচ্চিত্র; দিনকে দিন এর জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে। কী আছে এই চরিত্রটিতে?
নাম– প্রদোষ চন্দ্র মিত্র।
ডাক নাম– ফেলু।
পেশা– গোয়েন্দাগিরি।
পরিবার– বাবা জয় কৃষ্ণ মিত্র।
দাম্পত্য সঙ্গী– নেই, অবিবাহিত।
বন্ধু– লালমোহন গাঙ্গুলি।
বয়স– প্রায় ২৭ বছর।
উচ্চতা– ৬ ফুট ২ ইঞ্চি।
ঘর– ২১ রজনী সেন রোড কোলকাতা।
প্রথম উপস্থিতি– ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি।
শেষ উপস্থিতি– রবার্টসনের রুবি।
দক্ষতা
ফেলুদা মার্শাল আর্টে বিশেষ দক্ষ। যদিও অসম্ভব ভালো বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের ক্ষমতার ওপরেই যে কোনও রহস্যের সমাধানে সে আস্থা রাখতে ভালোবাসে। তাঁর এই বিশেষ ক্ষমতাকে সে মজা করে বলে থাকে মগজাস্ত্র। যদিও বাড়তি সতর্কতার জন্য তাঁর নিজস্ব .৩২ কল্ট রিভলভার রয়েছে। রিভলভার থেকে গুলি চালাতে ফেলুদাকে খুব কম গল্পেই দেখা যায়। যদিও সাম্প্রতিক ফেলুদার সিনেমাগুলোর প্রায় সবকটায় ফেলুদাকে গুলি চালাতে দেখা গেছে।

অভ্যাস
ফেলুদার রহস্য অনেকসময়েই কলকাতার বাইরেও বিস্তারলাভ করে, এমনকি অনেক সময়ে তা দেশের গন্ডিও ছাড়িয়ে যায়। পাড়াগাঁয়েও ফেলুদাকে দেখা গেছে গোয়েন্দাগিরি ক্রতে। রহস্যের বিস্তার যেখানেই ঘটুক না কেন, সেই জায়গা সম্পর্কে বিস্তারিত পড়াশুনো করে যাওয়া ফেলুদার অভ্যাস।
জীবনযাপন
মাত্র নয় বছর বয়সে মা-বাবা মারা যাওয়ায় ফেলুদা তাঁর বাবার বড় ভাইয়ের কাছেই মানুষ হয়েছেন। ফেলুদার বাবা জয়কৃষ্ণ মিত্র ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে গণিত ও সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন। ফেলুদা পেশায় গোয়েন্দা হলেও, এটা নেশাও বটে। গোয়েন্দাগিরি শুরুর আগে ফেলুদাও একটি স্কুলে কিছুদিন পড়িয়েছেন। স্কটিশচার্চ কলেজের প্রাক্তন এই ছাত্রটি পড়ানোকে খুবই উপভোগ করতেন। তোপসে তার সহকারী হলেও সম্পর্কে তার কাকাতো ভাই। তার নেশা বলতে সিগারেট। সিগারেটের প্রিয় ব্র্যান্ড চারমিনার। ফেলুদা প্রতিদিন সকালে নিয়মিত শরীরচর্চা ও যোগব্যায়ামে অভ্যস্ত। প্রচুর বই পড়া ও সাম্প্রতিক তথ্য সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ থাকা গোয়েন্দা হিসেবে পেশাগত দিক দিয়েও তাকে অনেক এগিয়ে রাখে।
পার্শ্বচরিত্রগুলো:
তপেশরঞ্জন মিত্র
ফেলুদার খুড়তুতো ভাই। ফেলুদার দেওয়া তোপসে নামেই অধিক পরিচিত। এই চরিত্রটি আর্থার কনান ডয়েলের জন ওয়াটসন চরিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত। তোপসে ফেলুদার সর্বক্ষণের সঙ্গী। ফেলুদার প্রায় সব অভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সে লিপিবদ্ধ করে। তোপসের বাবা সম্পর্কে ফেলুদার কাকা। ফেলুদা তার কাকার পরিবারেরর সঙ্গেই ২১, রজনী সেন রোড, কলকাতা-৭০০০২৯-র বাড়িতে থাকে। দক্ষিণ কলকাতায় রজনী সেন রোড থাকলেও ২১ নম্বর বাড়িটি অস্তিত্বহীন। তোপসে চরিত্রে নানা সময়ে সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন। সর্বশেষ ফেলুদা চলচ্চিত্রে তোপসের ভূমিকা পালন করেছেন সাহেব ভট্টাচার্য্য।
লালমোহন গাঙ্গুলি
ফেলুদার বন্ধু। ইনি জটায়ু ছদ্মনামে রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখেন। লালমোহনবাবু বাংলায় রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের একজন জনপ্রিয় লেখক এবং তার নিজের মতে সারা ভারতে তার অনুগামীরা ছড়িয়ে আছে। তাঁর লেখা উপন্যাসগুলির প্রধান চরিত্র সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট গোয়েন্দা প্রখর রুদ্র। তাঁর অবিশ্বাস্য গল্পগুলি বেস্টসেলার হলেও বইগুলোতে মাঝে মাঝে খুবই সাধারণ ভুল থাকে, যেগুলো ফেলুদাকে শুধরে দিতে হয়। লালমোহনবাবুর একটি ‘মাদ্রাজী সবুজ’ এ্যাম্বাসেডর গাড়ি আছে যা ফেলুদার অনেক অভিযানের নির্ভরযোগ্য বাহন।

জটায়ু
সোনার কেল্লা গল্পে ফেলুদা ও তোপসের যোধপুর গমনকালে কানপুরে ট্রেনে প্রথম জটায়ু চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে। সন্তোষ দত্ত সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে জটায়ুর ভূমিকা পালন করেন। সত্যজিৎ রায় প্রথম ফেলুদা ছবির পর জটায়ু চরিত্রে রদবদল ঘটিয়ে তাকে অনেকটা সন্তোষ দত্তের মতই গড়ে তোলেন। রবি ঘোষ ও বিভু ভট্টাচার্য্য পরবর্তীকালে এই চরিত্রে অভিনয় করেন। নয়ন রহস্য গল্পে লেখক জটায়ুকে ‘বিদূষক’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
সিধুজ্যাঠা
ফেলুদার বাবার বন্ধু। ফেলুদাকে প্রায়ই অসাধারণ স্মৃতিশক্তি এবং সাধারণ জ্ঞানের অধিকারী সিধুজ্যাঠার কাছে বিভিন্ন জিজ্ঞাসা নিয়ে দ্বারস্থ হতে হয়।
মগনলাল মেঘরাজ
ফেলুদার অন্যতম শত্রু। ফেলুদা বেশ কয়েকটি কাহিনীতে তার মোকাবিলা করে। জয় বাবা ফেলুনাথ এবং যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে এর মধ্যে প্রধান। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় জয় বাবা ফেলুনাথ চলচ্চিত্রে মগনলাল মেঘরাজের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত।
প্রকাশ
ফেলুদা কাহিনী প্রথম পূজাবার্ষিকী দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। অল্প কিছু কাহিনী প্রকাশিত হয়েছিলো সন্দেশ পত্রিকায়। বইগুলির বাঁধাই কপি প্রকাশিত হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। এছাড়া ফেলুদার উপরে কমিক স্ট্রিপ-ও প্রকাশিত হয়েছে। অধিকাংশ ফেলুদা বইয়ের প্রচ্ছদ এবং অলঙ্করণ সত্যজিৎ রায়ের নিজের আঁকা। ফেলুদা সিরিজের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস ইংরেজি ভাষাতে অনুদিত হয়েছে।
টেলিভিশনে ফেলুদা
এখন পর্যন্ত ফেলুদার এগারোটি কাহিনী চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ এবং সত্যজিতের পুত্র সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় বাক্স রহস্য (১৯৯৬) , বোম্বাইয়ের বোম্বেটে (২০০৩) , কৈলাসে কেলেঙ্কারী (২০০৭) , টিনটোরেটোর যীশু (২০০৮) , গোরস্থানে সাবধান (২০১০) , রয়েল বেঙ্গল রহস্য (২০১১) , বাদশাহী আংটি (২০১৪) , ডবল ফেলুদা (২০১৬) । ডবল ফেলুদা চলচ্চিত্রটি ‘সমাদ্দারের চাবি’ আর ‘গোলকধাধা রহস্য’ এই দুইটি উপন্যাস নিয়ে একসাথে করা হয়েছে। সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমায় ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, এবং বোম্বাইয়ের বোম্বেটে থেকে পরবর্তী সকল সিনেমায় অভিনয় করেন।

গোয়েন্দা উপন্যাস ফেলুদা সমগ্র (১ ও ২ একত্রে)
সব্যসাচী চক্রবর্তী। সব্যসাচী চক্রবর্তী সিনেমা ছাড়াও ডাঃ মুনসীর ডায়েরী নামে টেলিফিল্মে এবং সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় ফেলুদার উপরে নির্মিত টিভি সিরিয়ালে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন । ২০১৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর বাদশাহী আংটি চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছে। যাতে জনপ্রিয় অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায় কে ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে। ফেলুদা কাহিনীর সাম্প্রতিকতম চলচ্চিত্র ‘ডবল ফেলুদা’ ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ মুক্তি পেয়েছে। এতে ফেলুদার ভূমিকায়ে সব্যসাচী চক্রবর্তী আবার ফিরে এসেছেন।
সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস নামের হিন্দি ভাষার সিরিজে কিসসা কাটমান্ডু কা’ (যত কান্ড কাটমুন্ডুতে) নামক ফেলুদা কাহিনী টিভিতে দেখানো হয়েছিলো তাতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেন শশী কাপুর এবং লালমোহনবাবুর ভূমিকায় অভিনয় করেন মোহন আগাসে।
পরিসংখ্যান
অধিকাংশ ফেলুদা কাহিনী প্রথম পূজাবার্ষিকী দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। অল্প কিছু কাহিনী প্রকাশিত হয়েছিল সন্দেশ পত্রিকায়। বইগুলোর বাঁধাই কপি প্রকাশিত হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। এ ছাড়া ফেলুদার উপরে কমিক স্ট্রিপও প্রকাশিত হয়েছে। অধিকাংশ ফেলুদা বইয়ের প্রচ্ছদ এবং অলঙ্করণ সত্যজিৎ রায়ের নিজের আঁকা। ফেলুদা সিরিজের সব গল্প ও উপন্যাস ইংরেজি ভাষাতে অনূদিত হয়েছে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ফেলুদা সিরিজের মোট ৩৫টি সম্পূর্ণ ও চারটি অসম্পূর্ণ গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। ফেলুদার কাহিনি নিয়ে সিনেমা, টিভি সিরিজ, টেলিফিল্ম- এক কথায় সবই নির্মিত হয়েছে।
comments (0)