শিক্ষকতা একটি মহান পেশা আর শিক্ষকেরা আমাদের ছেলেবেলার নায়ক। ছোটবেলা থেকে অনেকেই স্বপ্ন দেখেন তার পছন্দের শিক্ষকের মতো একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার। প্রাচীন গ্রিসে সক্রেটিসের সময় থেকে আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে অনেক পেশা হারিয়ে গেছে, অনেক পেশার উত্থান ঘটেছে, কিন্তু শিক্ষকতা টিকে আছে তার সম্মানের জায়গায়। শিক্ষক হতে চাইলে কী করণীয় — অনেকেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। সহজ উত্তর হলো, শেখাতে হলে আগে শিখতে হবে। অর্থাৎ, আপনি স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় — যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক হতে চান না কেন, আগে নিজের পড়ালেখাটা করতে হবে মন দিয়ে। নিজেকে গড়তে হবে একজন আদর্শবান, মানবিক মানুষ হিসেবে। এর বাইরেও কিছু শিক্ষাগত যোগ্যতা, কিছু নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে আমরা যখন জানতে চাই, জীবনের লক্ষ্য কী? একটা বড় অংশই বলে — শিক্ষক হতে চাই। আর তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে স্কুল ও কলেজের শিক্ষক হওয়া। এই পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করার ক্ষেত্রে বর্তমানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীরা পরবর্তীতে বিভিন্ন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবে। বর্তমানে দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা) নিবন্ধন ছাড়া চাকরির কোনো সুযোগ নেই।
শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্য থেকে মেধা তালিকার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। তাই স্কুল-কলেজের শিক্ষকতা করার স্বপ্ন যাদের, তারা এখন থেকেই নিজেদের সময়কে কাজে লাগিয়ে পৌঁছে যেতে পারেন নিজ লক্ষ্যে।
এখন তবে জেনে নেওয়া যাক, শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার বৃত্তান্ত —
আবেদনের যোগ্যতা
শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় আবেদন করতে হলে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কমপক্ষে স্নাতক বা সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। তবে সমগ্র শিক্ষাজীবনে যেকোনো একটি তৃতীয় বিভাগ বা সমমান জিপিএর ফলাফল গ্রহণযোগ্য হবে। সদ্য উত্তীর্ণ প্রার্থীরা সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্তৃক প্রদত্ত প্রশংসাপত্র, টেবুলেশন শিট বা নম্বরপত্র ও প্রবেশপত্র মৌখিক পরীক্ষায় প্রদর্শনের মাধ্যমে আবেদন করতে পারবেন। কিন্তু পরীক্ষায় অবতীর্ণ প্রার্থীরা আবেদন করতে পারবে না।
আবেদন প্রক্রিয়াঃ
অনলাইনে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার জন্য আবেদন করতে হয়। এ জন্য ntrca.teletalk.com.bd এই ঠিকানায় গিয়ে যথাযথভাবে ফরম পূরণ করে নিবন্ধন করতে হবে। আবেদন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সমপন্ন হলে পরীক্ষার্থীকে একটি নম্বর দেওয়া হয়। এই নম্বর দিয়ে যেকোনো টেলিটক মোবাইল থেকে পরীক্ষার ফি বাবদ ৩৫০ টাকা প্রদান করতে হয়। আবেদন করার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে টাকা জমা দিতে হয়, অন্যথায় আবেদনপত্র বাতিল বলে গণ্য করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা জমা দেওয়ার পর প্রার্থীকে ইনভয়েস নম্বর এবং পাসওয়ার্ডের সিরিয়াল নম্বর ফিরতি এসএমএসয়ের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। এই পাসওয়ার্ড ও ইনভয়েস নম্বর দিয়ে ওয়েবসাইট থেকে পরীক্ষার প্রবেশপত্র সংগ্রহ করতে হয়। অনলাইনে পূরণকৃত আবেদনপত্রের একটি প্রিন্টেড কপি সংরক্ষণ করতে হয় এবং এসএমএসয়ের মাধ্যমে পাওয়া সিরিয়াল নম্বরটি প্রিন্ট কপির নির্দিষ্ট স্থানে উল্লেখ করতে হয়।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
আবেদনপত্রের সঙ্গে পরীক্ষার্থীর স্বাক্ষর ও নীল ব্যাকগ্রাউন্ডযুক্ত পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি স্ক্যান করে আবেদনপত্রের নির্দিষ্ট স্থানে সংযুক্ত করতে হয়। আবেদনপত্রের প্রিন্ট কপির সঙ্গে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র, নম্বরপত্র, প্রশিক্ষণ সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), নাগরিকত্বের সনদ ইত্যাদি প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তা কর্তৃক সত্যায়িত করে সংযুক্ত করে ডাকবাক্সের মাধ্যমে পাঠাতে হয়। এ জন্য ‘স্কুল শিক্ষক নিবন্ধন’ পরীক্ষার্থীদের হলুদ খামে এবং ‘কলেজ শিক্ষক নিবন্ধন’ পরীক্ষার্থীদের খাকি খামে করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ, নায়েম ক্যাম্পাস, একাডেমিক ভবন (ষষ্ঠ তলা), ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৫ এই ঠিকানায় ডাকযোগে পাঠাতে হবে। খামের ওপর অবশ্যই কততম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার জন্য আবেদনপত্র, পদের নাম এবং বিষয়ের নাম স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে হবে।
পরীক্ষা পদ্ধতি ও মানবন্টন
প্রথমে অনুষ্ঠিত হবে ১০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। পরীক্ষা হবে এমসিকিউ পদ্ধতিতে, সময় থাকবে এক ঘণ্টা। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ও সাধারণ জ্ঞান অর্থাৎ ৪টি বিষয় থেকে প্রশ্ন করা হবে। প্রতিটি বিষয় থেকে ২৫টি করে প্রশ্ন থাকবে প্রিলিমিনারিতে। প্রতিটি সঠিক উত্তরের জন্য বরাদ্দ ১ নম্বর এবং প্রত্যেক ভুল উত্তরের জন্য ০.৫০ নম্বর কাটা যাবে। এ পরীক্ষায় পাস করতে হলে ৪০ নম্বর পেতে হবে।
এরপর প্রিলিমিনারি টেস্টে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। সময় থাকবে ৩ ঘণ্টা। লিখিত পরীক্ষাতেও পাস নম্বর ৪০। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের এনটিআরসি কর্তৃক প্রদত্ত তারিখে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে।
লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার সময় এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হবে। নির্ধারিত তারিখে সঙ্গে আনতে হবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। এসএমএস-এ প্রাপ্ত নির্দেশনা মোতাবেক নির্বাচিত প্রার্থীগণ-কে ২০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। মৌখিক পরীক্ষার নম্বরের ২টি অংশ থাকবে — শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্রের ওপর ১২ নম্বর ও প্রশ্ন-উত্তরের ওপর ০৮ নম্বর। মৌখিক পরীক্ষার উভয় অংশে অন্যূন শতকরা ৪০% নম্বর না পেলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী জাতীয় মেধাতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেন না।
এই লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতেই উপজেলা, জেলা ও জাতীয় মেধাতালিকা তৈরি করা হবে।
বিষয়-ভিত্তিক সিলেবাস ও সহায়ক বই
❖ বাংলা
স্কুল ও কলেজ উভয় পর্যায়েই বাংলা ব্যাকরণ অংশের মধ্যে ভাষারীতি ও বিরাম চিহ্নের ব্যবহার, কারক বিভক্তি, সমাস, প্রত্যয়, সন্ধি বিচ্ছেদ, বাগধারা ও বাগবিধি, সমার্থক ও বিপরীতার্থক শব্দ, যথার্থ অনুবাদ, বাক্য সংকোচন, ভুল সংশোধন ও লিঙ্গ পরিবর্তন থেকে প্রশ্ন আসে। ব্যাকরণ ছাড়াও বাংলা সাহিত্য থেকে প্রশ্ন আসে। স্কুল পর্যায়ের জন্য নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক, বোর্ড প্রণীত ব্যাকরণ ও বাংলা প্রথম পত্র বইটি ভালোভাবে পড়তে হবে এবং কলেজ পর্যায়ের জন্য একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড বইটিও দেখতে হবে। প্রথম পত্র বইয়ের প্রতিটি গদ্য ও পদ্যের লেখক পরিচিতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।
❖ ইংরেজি
ইংরেজিতে বেশির ভাগ প্রশ্নই গ্রামারের ব্যবহার থেকে করা হয়। গ্রামার অংশের মধ্যে আছে আর্টিকেল, পার্টস অব স্পিচ, অ্যাপ্রোপ্রিয়েট প্রিপজিশন, ভার্ব, ভয়েস, ন্যারেশন, ট্রান্সফরমেশন, কারেকশন ইত্যাদি। এছাড়া, কমপজিশন অংশের মধ্যে প্যারাগ্রাফ, লেটার, অ্যাপ্লিকেশন, পাংচুয়েশন, ক্রিয়েটিভ রাইটিং ও রচনা। গ্রামার অংশে ভালো করার জন্য বারবার চর্চার সাথে সাথে বিগত বছরের প্রশ্নগুলোও সমাধান করতে হবে।
❖ গণিত
পাটিগণিত অংশের মধ্যে ঐকিক নিয়ম, লাভ-ক্ষতি, শতকরা, সুদকষা, গড়, ল.সা.গু, গ.সা.গু, অনুপাত-সমানুপাত, বীজগণিত অংশের মধ্যে মূলদ ও অমূলদ সংখ্যা, ফাংশন, উত্পাদক নির্ণয়, বর্গ ও ঘন, সূচক ও লগারিদমের সূত্রের প্রয়োগ এবং জ্যামিতির মধ্যে রেখা, কোণ, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, ক্ষেত্রফল ও বৃত্ত, পরিমিতি ও ত্রিকোণমিতি থেকে প্রশ্ন আসে।
পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতির সাধারণ ধারণা, বিভিন্ন সূত্র, নিয়মাবলি ও এর প্রয়োগ থেকে প্রতি বছরই প্রশ্ন করা হয়। স্কুল পর্যায়ের জন্য ৮ম থেকে ১০ম শ্রেণির গণিত বইয়ের প্রতিটি নিয়মের অংক সমাধান করতে হবে এবং কলেজ পর্যায়ের জন্য একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বইয়ের সমাধান করতে হবে।
❖ সাধারণ জ্ঞান
সাধারণ জ্ঞান অংশে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পরিবেশ, রোগব্যাধি ও চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে প্রশ্ন আসে। বাংলাদেশ অংশে রয়েছে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু, ইতিহাস ও সভ্যতা, সংস্কৃতি, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, অর্থনীতি, বিভিন্ন সম্পদ; আন্তর্জাতিক অংশ থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা, বিভিন্ন দেশ পরিচিতি, মুদ্রা, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ, আন্তর্জাতিক দিবস, পুরস্কার ও সম্মাননা, খেলাধুলা; প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, রোগব্যাধি, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ এবং সাম্প্রতিক বিষয়ের প্রতি একটু বেশি নজর দিতে হবে। যেমনঃ বিশ্বকাপ ক্রিকেট, পাকিস্তান দলের বাংলাদেশ সফর, এ বছরের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রভৃতি।
লিখিত পরীক্ষা
সিলেবাস অনুযায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বই থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। এমনকি প্রয়োজনে স্নাতক পর্যায়ের বই থেকেও প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে। লিখিত পরীক্ষায় প্রতিটি প্রশ্নেরই বিকল্প প্রশ্ন থাকে।
নিবন্ধন পরীক্ষায় স্কুল ও কলেজ উভয় পর্যায়ে ভালো করার জন্য ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বোর্ড বই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর কলেজ পর্যায়ের জন্য একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড বই দখলে রাখতে হবে। অন্যদিকে, সাধারণ জ্ঞানের জন্য আজকের বিশ্ব, নতুন বিশ্ব, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের মতো তথ্যভিত্তিক বইগুলো বেশ উপকারী।
পরীক্ষার হলে বিষয় কোড, সেট নম্বর ও রোল নম্বর আবশ্যিক বিষয়ের ওএমআর উত্তরপত্রের নির্দিষ্ট স্থানে এবং ঐচ্ছিক বিষয়ের উত্তরপত্রে ওএমআরের প্রথম অংশের নির্ধারিত স্থানে লিখতে হবে ও বৃত্ত ভরাট করতে হবে।
আরও জেনে রাখা প্রয়োজন —
১। এম.পি.ও. নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী বেসরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পদে নিয়োগের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ (পঁয়ত্রিশ) বছর।
২। চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের তারিখ হতে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের সনদপত্র অনলাইন আবেদনপত্রে উল্লিখিত তাঁদের স্থায়ী ঠিকানার জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে ওয়েবসাইটে দেওয়া ফলাফল সাময়িক প্রত্যয়নপত্র হিসেবে গণ্য করা হয়।
– ফারহানা ইয়াসমিন
শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় বইগুলো দেখুন