শিশুদের শারিরীক স্বাস্থ্যের প্রতি বেশিরভাগ অভিভাবকই সচেতন। সেই তুলনায় খুব কম সচেতন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি। এই মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার অন্যতম উপায় হচ্ছে বই পড়া। সে জন্য পাঠ্যবইয়ের বাইরেও বিভিন্ন বিষয়ের বই তাদেরকে কিনে দিতে হবে৷ এতে করে তারা বিনোদনের পাশাপাশি ভাষা ও সৃজনশীল বিভিন্ন বিষয়ে ধীরে ধীরে দক্ষ হয়ে উঠবে। পড়াও যে উপভোগের বিষয়—তা অনুধাবন করতে পারবে। পাঠ্যবই তাদের কাছে আর বিরক্তির মনে হবে না। এটিও উপভোগ করার চেষ্টা করবে।
শিশুদের বই কিনে দেওয়ার ক্ষেত্রে একজন অভিভাবককে বেশ সতর্ক থাকতে হয়। যেকোনো বই কিনে দেওয়া তাদের জন্য উপকারী নয়। বই কেনার ক্ষেত্রে নিম্নের এ বিষয়গুলো অভিভাবকদের খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি :
০১. নির্ভুল বানানের বই কিনা যাচাই করুন
শিশুতোষ বইয়ের বানান খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ শিশুরা দেখে দেখে শেখে। ভুল বানানের বই তাদের হাতে তুলে দিলে তারা ভুল বানানই শিখবে। সঠিক বানানের বই তুলে দিলে তারা সঠিক বানানই শিখবে। সুতরাং অভিভাবকদের সতর্কতার বিকল্প নেই। কোনোভাবেই শিশুদের হাতে ভুল বানানের বই তুলে দেওয়া যাবে না। বই কেনার সময় এ বিষয়টি ভালোভাবে যাচাই করে নিন।
০২. বইয়ে ব্যবহৃত শব্দগুলো শিশুদের উপযোগী কিনা দেখে নিন
বানানের পর শিশুতোষ বইয়ের শব্দও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকসময় শিশুতোষ বইয়ে শিশুদের উপযোগী শব্দ থাকে না। কঠিন শব্দ দিয়ে সয়লাব থাকে। ফলে পড়াগুলো বুঝতে গিয়ে শিশুদের ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হয়। সুতরাং তাদেরকে কিনে দিতে হবে শিশুদের উপযোগী সহজ শব্দের বই।
০৩. বড়ো ও কঠিন বাক্যের বই তুলে দেবেন না
ছোটো ছোটো ও সহজ বাক্য দিয়ে রচিত বইগুলো শিশুরা পছন্দ করে। পড়ার সঙ্গেসঙ্গে বইয়ের কথাগুলো বুঝতে পারে তারা। বড়ো ও কঠিন বাক্যের বই তাদের হাতে তুলে না দেওয়াই ভালো। কেননা, পড়ার সঙ্গেসঙ্গেই কথাগুলো বুঝতে না পারলে পাঠে বিরক্তি আসে। ব্রেন খুব দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যায়। কোনোভাবেই বইটি উপভোগ্য হয়ে ওঠে না।
০৪. বইয়ের বিষয়বস্তু শিশুদের উপযোগী কিনা দেখুন
শিশুদেরকে বই কিনে দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখতে হবে বইটি তাদের উপযোগী কিনা। বড়োদের উপযোগী বই কোনোভাবেই তুলে দেবেন না। শিশুদের হাতে তুলে দিতে হবে ঠিক তাদের উপযোগী বই। এর ব্যতিক্রম হলে সে বইটি পড়ে উপভোগ করতে পারবে না। পড়ার প্রতি আগ্রহ নষ্ট হবে। সুতরাং তাদের চিন্তার জগৎ নিয়ে লেখা—এমন বইগুলো তাকে কিনে দিন।
দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউ পি এল)-এর শিশুকিশোর বইগুলো তুলে দিতে পারেন। প্রতিবছর তারা শিশুদের উপযোগী চমৎকার চমৎকার সব বই প্রকাশ করে আসছে। শিশুদের কৌতুহল ও বিস্ময় মেটাতে এ বইগুলো ভীষণ সাহায্য করবে। সমৃদ্ধ করবে তাদের চিন্তার জগতকে।
০৫. উদ্ভট প্রচ্ছদ ও অলংকরণের বই কেনা থেকে বিরত থাকুন
অনেক সময় শিশুতোষ বইয়ে উদ্ভট প্রচ্ছদ ও অলংকরণ ব্যবহার হতে দেখা যায়। বইয়ের নামের সঙ্গে প্রচ্ছদের মিল থাকে না। বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্যতা থাকে না অলংকরণের। এ ধরনের বইগুলো কেনা থেকে বিরত থাকুন। কেননা, শিশুরা কোনোকিছু পড়ার পর পাশে জুড়ে দেওয়া ছবিটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে। তাদের কল্পনানুযায়ী সেসব ছবিগুলো না হলে বই পড়ে মোটেও উপভোগ করতে পারে না।
০৬. মানসিক বিকাশ বৃদ্ধি করতে পারে—এমন বই কিনে দিন
অবাস্তব ও বিকৃত বিষয়বস্তুর বইগুলো শিশুদের কাছ থেকে দূরে রাখুন। তাদের হাতে এমন বইগুলো তুলে দিন—যে বইগুলো তাদের মানসিক বিকাশ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষণীয় ও উপদেশমূলক গল্প-ছড়ার বইগুলো নিশ্চিন্তে কিনে দিতে পারেন।
০৭. শিশুরা যে বিষয়ে আগ্রহী সে বিষয়ের বই তুলে দিন
অভিভাবককে বুঝতে হবে, তার শিশুটি কোন বিষয়ে ভীষণ আগ্রহী৷ শুরুর দিকে সেই বিষয়ের বই-ই কিনে দিতে হবে তাকে। ছড়া, গল্প, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, কমিক্স—যেটিতে তার আগ্রহ রয়েছে সেটিই শিশুটির হাতে তুলে দিন৷ পড়ায় মজা পেয়ে গেলে সে অন্য বিষয়ের বইগুলোও পড়ার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে।
এ ক্ষেত্রে অক্ষরবৃত্ত প্রকাশন এর শিশুকিশোর বইগুলোও তুলে দিতে পারেন। মানসম্মত শিশুকিশোরদের বই প্রকাশের জন্য ইতোমধ্যেই এ প্রকাশনীর বইগুলো শিশুমহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। প্রতিবছরই তারা খ্যাতিমান ও প্রতিশ্রুতিশীল লেখকদের ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, থ্রিলার, প্রবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, সায়েন্স ফিকশন, শিশুসাহিত্যের সকল শাখার বইগুলো প্রকাশ করে থাকেন৷ তাদের শিশুকিশোর বইগুলোর কনটেন্ট, কাগজের মান ও অলংকরণ শিশুদের বই পড়ার প্রতি ভীষণ আগ্রহী করে তুলবে।
০৮. শিশুদের বয়সকে প্রাধান্য দিন
বই কিনে দেওয়ার ক্ষেত্রে শিশুদের বয়স খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অভিভাবকগণ বয়সের বিষয়টিও মাথায় রাখুন। যে শিশুটির বয়স ০১-০৫ বছর সে খুবই ছোট্টো শিশু। সবেমাত্র কথা বলা শিখেছে । বানান করে পড়তে পারে হয়তো! সাধারণত এমন শিশুর ভালো লাগে সহজ শব্দ ও বাক্যের বই। রাজা-রানি, ডাইনি, দৈত্য, জাদুকর ইত্যাদি রূপকথাটাইপ গল্প সে খুব পছন্দ করে। তার জন্য ঠিক এমন বিষয়ের বইগুলো বাছাই করুন। শুধু কল্পনাশ্রিত বই-ই নয়, বিভিন্ন নীতিকথার বইও তুলে দিতে পারেন। যেসব বইয়ের গল্পে উঠে আসে সকালে ঘুম থেকে ওঠা ভালো, মিথ্যে বলা পাপ, ঝগড়া করা উচিত নয় ইত্যাদি নীতিবাচক বিষয়। সাধারণত যুক্তবর্ণহীন বইগুলো তার জন্য উপযুক্ত। কমিক্সের বইও ভীষণ পছন্দ করে সে। সুতরাং তাকে এ বিষয়ের বইগুলোই কিনে দিন।
যার বয়স ০৫-১১ বছর; তুলনামূলক সে একটু বড়ো শিশু। স্পষ্ট কথা বলতে পারে। ভালো করে পড়তে জানে। মোটামুটি বড়ো বাক্য পড়েও বুঝতে পারে সে। যুক্তাক্ষরের শব্দগুলো বুঝতেও কোনো অসুবিধা হয় না। বিশেষ করে দস্যিপনার বিষয়গুলো তার ভালো লাগে। সায়েন্স ফিকশনেও বিশেষ আগ্রহ থাকে। সুতরাং তাকে এমন বইগুলোই কিনে দিন।
০৯. ০১-০৫ বছর বয়সী শিশুদের হাতে যে বইগুলো তুলে দিতে পারেন

গুফি-র ‘বর্ণ নিয়ে খেলি (স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জনবর্ণ)‘ সিরিজের বইগুলো ০১-০৫ বছর বয়সী বাচ্চাদের জন্য বেশ উপযোগী ও উপকারী হতে পারে। এই সিরিজটি সাজানো হয়েছে বিভিন্ন ক্রিয়েটিভ এবং ইন্টারএক্টিভ গেম, ছবি, পাজেল দিয়ে। মোট ১০টি বই রয়েছে এখানে। এ বইগুলো পড়ার মাধ্যমে শিশুরা খুব দ্রুতই বর্ণমালা শিখতে পারবে।

গুফি-র ‘বর্ণ গল্প— ২ (মূল্যবোধ ও নৈতিকতা)‘ সিরিজের বইগুলোও এ বয়সের শিশুরা বেশ উপভোগ করবে। একটি বাংলা বর্ণ দিয়ে একটি মজার ও শিক্ষণীয় গল্প তুলে ধরা হয়েছে বইগুলোতে। এই সিরিজে মোট ৫টি বই রয়েছে। এ বইগুলো পড়লে বর্ণ দিয়ে দারুণ দারুণ শব্দ শিশুরা খুব সহজেই আয়ত্ত করতে পারবে।

ওয়ার্ল্ড অব চিলড্রেন’স বুকস লিমিটেড এর ‘ছবি দেখি, গল্প শুনি– ১‘ সিরিজে ০১-০৫ বছর বয়সী শিশুদের ২০টি বই রয়েছে। সহজ ভাষায় বইগুলো রচনা করা হয়েছে। গল্প ও ছবিগুলো বাচ্চাদের মুগ্ধ করবে। সদ্য পড়তে শেখাদের জন্য এটি খুবই উপকারী একটি সিরিজ। এর ইংরেজি ভার্সনও রয়েছে৷ চাইলে সেটিও সংগ্রহ করা যেতে পারে।
পাঞ্জেরী পাবলিকেশনও শিশুদের অসাধারণ সব বই নিয়ে কাজ করছে। বিশেষ করে তাদের কমিক্সের বইগুলো শিশুদের কাছে বেশি সমাদৃত৷ এ ছাড়াও বয়সভিত্তিক শিশুদের বইও তারা প্রকাশ করে আসছে। প্রকাশনীটি তাদের বইগুলো মানের ব্যাপারে ভীষণ সচেতন।

অ্যাডর্ন বুক্স ফর চিলড্রেন (এবিসি)-এর ‘ছোট্ট বই সিরিজ‘ বইগুলো বাচ্চাদের নজর কাড়বে। এই সিরিজে ০১-০৫ বছর বয়সী শিশুদের ১২টি রঙিন বই রয়েছে। সাধারণত ২ বছর বয়স থেকেই একটি শিশুর পড়ালেখার হাতেখড়ি শুরু হয়। এরা আগে ছবি দেখে পরে গল্প পড়ায় আগ্রহী হয়। এ সিরিজের প্রতিটি বইয়ে আছে বড়ো বড়ো রঙিন ছবি আর ছোট্টো ছোট্টো বাক্য। সব্যসাচী মিস্ত্রির আঁকা প্রতিটি ছবিওয়ালা বইগুলো শিশুদের মুগ্ধ করবে।
এ ছাড়া ০৩-০৫ বছর বয়সী শিশুদের ইংরেজি এ বইগুলো তুলে দিতে পারেন : দ্য হাংরি ক্যাটারপিলার (এরিক কার্লে), গুডনাইট মুন (মার্গারেট ওয়াইজ ব্রাউন), দ্য টেল অব পিটার র্যাবিট (বিটরিক্স পটার), জিরাফস ক্যান্ট ড্যান্স (গাইলস অ্যান্ড্রিউ গাই পার্কার-রিস) ইত্যাদি।

১০. ০৫-১১ বছর বয়সী শিশুদের হাতে যে বইগুলো তুলে দিতে পারেন
ওয়ার্ল্ড অব চিলড্রেন’স বুকস লিমিটেড এর ‘চিরকালের রূপকথার সিরিজ‘ ০৫-১১ বছর বয়সী শিশুদের জন্য বেশ উপযোগী। মোট ২০টি বই দিয়ে এই সিরিজটি সাজানো হয়েছে। রূপকথা, উপকথা ও লোককাহিনির অনবদ্ধ সব গল্প এখানে সংকলিত আছে। এ বইগুলোর সঙ্গে শিশুদের সময় বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠবে।
ইকরি মিকরির শিশুকিশোর বইগুলো এ বয়সী শিশুদের জন্য অনবদ্ধ সংকলন হতে পারে। লেখার মান, কাগজের কোয়ালিটি ও চমৎকার ছবি দিয়ে ইতোমধ্যেই তারা শিশুদর মনে স্থান করে নিয়েছে।
শিশুদের জন্য অসাধারণ ও চমকপ্রদ সুন্দর বই প্রকাশ করছে ময়ূরপঙ্খি প্রকাশনী। তাদের বইগুলো মনকাড়া সহজ ভাষায় রচিত, আধুনিক নকশায় সজ্জিত ও উন্নতমানের বাঁধাই। দেশবিদেশের বরেণ্য লেখক ও শিল্পীদের সমন্বয়ে তারা বই তৈরি করছে। এ বইগুলো শিশুদের নজর কাড়তে বাধ্য করবে।
এ ছাড়া ০৫-১১ বছর বয়সী শিশুদের ইংরেজি এ বইগুলো তুলে দিতে পারেন : হয়্যার দ্য ওয়াইল্ড থিংস আর (মরিস স্যানডাক) ও দ্য ক্যাট ইন দ্য হ্যাট (ড. সিউস), বিবপ সিরিস (অ্যানি বিসান্ট), ফাইভ অন এ ট্রেজার আইল্যান্ড (এনিড ব্লাইটন), এ বিয়ার কলড প্যাডিংটন (মাইকেল বন্ড), চার্লটস ওয়েব (ইবি হোয়াইট) ইত্যাদি।
শিশুদের বই কিনে দেওয়ার ক্ষেত্রে উপরিউক্ত বিষয়গুলো অভিভাবকদের খেয়াল রাখা জরুরি। কেননা, বাংলাদেশে প্রতিবছর অসংখ্য শিশুতোষ বই প্রকাশ হয়। কিন্তু বেশিরভাগ বইয়েরই বিষয়বস্তু নির্বাচনে ছোটোদের মনের কথা নেই, বানান ভুলে সয়লাভ, মানহীন ছড়া, ভূতের গল্পের নামে আজগুবি বর্ণনা, নিম্নমানের ইলাস্ট্রেশন ও অসংলগ্ন প্রচ্ছদ জুড়ে দেওয়া থাকে। এ বইগুলো শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়। এতে তাদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হয় বেশি। সুতরাং অভিভাবকদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে শিশুদেরকে বই কিনে দিতে হবে।
শিশু কিশোরদের জন্য রকমারি বেস্টসেলার বই সমূহ দেখুন !