দার্শনিক, লেখক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশ্বজ্ঞানী স্বামী বিবেকানন্দ। কে না চেনে এই বিজ্ঞতপ্রসূত বিচক্ষণ বাঙালিকে? সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি: বিবিসি বাংলার জরিপে ১৭ নম্বর স্থানধারী স্বামী বিবেকানন্দের বহুল প্রচলিত রহস্যাবৃত এক ঘটনা দিয়ে তার পরিচয়কে একটু শক্ত করে তুলে ধরা যাক।
১৮৯৩ সালে শিকাগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ ভারত ও হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি তার দৃঢ ভাষণ দিয়ে বিশ্ব দরবারে ভারত এবং বাঙালির নাম রওশন করেছিলেন সেখানে। সম্মেলন থেকে ফেরার পথে তিনি এক জার্মান দার্শনিকের আতিথিয়তা গ্রহণ করেন। রাতের খাবার শেষে তারা যখন গল্প করছিলেন, সামনের টেবিলে রাখা ছিল জার্মান ভাষায় লেখা প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার একটি বই। চোখ পড়তেই বইটির ভীষণ প্রশংসা করলেন জার্মান দার্শনিক। এত প্রশংসা শুনে বিবেকানন্দ এক ঘন্টার জন্য বইটি তার কাছে ধার চাইলেন। তার প্রস্তাব শুনে দার্শনিক হেসে উঠে বলেছিলেন, মাত্র এক ঘন্টায় এই ভারী বইয়ের মর্যাদা কি বুঝবেন? কারণ, তিনি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পড়েও বইয়ের জটিল বিষয়গুলো উদ্ধার করতে পারেননি। তারপরও তিনি বিবেকানন্দের চাপাচাপিতে বইটি তার হাতে তুলে দিলেন। এরপরই ঘটলো চমক!
বিবেকানন্দ বইটি না খুলেই চোখ বন্ধ করে দুই হাতের মাঝে নিয়ে বসে থাকলেন। ঠিক ঠিক এক ঘন্টা বাদে বইটি মালিককে ফেরত দিয়ে বললেন, “বইটিতে বিশেষ কিছুই নেই।”
তার এই মন্তব্যে চটে গেলেন দার্শনিক। তিনি ভাবলেন, বিবেকানন্দ একজন অহংকারী পুরুষ। তাছাড়া, বিবেকানন্দ জার্মান ভাষাই তো জানেন না! তিনি বই না খুলেই এভাবে মন্তব্য করতে পারেন না। তারপর আরও একটি চমক দিলেন বিবেকানন্দ। তিনি বললেন, তাকে বই সম্পর্কে যেকোনো প্রশ্ন করা হোক, তিনি উত্তর দেবেন। দার্শনিক রাজি হয়ে তাকে ৬৩৩ পৃষ্ঠায় কী আছে জানতে চাইলেন। উত্তরে বিবেকানন্দ প্রমাণ দিলেন তার সমুদ্রসমান জ্ঞানের। অর্থাৎ এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন সেই পৃষ্ঠায় লেখা প্রতিটি শব্দ, যা ছিল সম্পূর্ণ সঠিক! সেই জার্মান দার্শনিক যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কীভাবে সম্ভব?” উত্তরে জ্ঞানী বললেন,
“এ কারণেই আমাকে সবাই বিবেকানন্দ বলে।”
বিবেক অর্থ বোধ। বিবেকানন্দের গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব সর্বপ্রথম তার মধ্যে এই বোধের উপস্থিতি টের পান। এরপর ১৮৮৬ সালে বিবেকানন্দ যখন তার গুরুকে অনুসরণ করে মাত্র ২৩ বছর বয়সে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ নামটি গ্রহণ করেন।
জন্মসূত্রে তার নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। উত্তর কলকাতার সিমলা এলাকার দত্ত পরিবারে ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি জন্ম তার। তার পরিবারে এমন একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে, দেবতা শিবের আশীর্বাদ নিয়েই নরেন্দ্রের জন্ম। কারণ তার মা শিবের কাছে একটি পুত্রসন্তান কামনা করেছিলেন। শৈশব থেকেই তার মধ্যে অপার্থিব ধ্যান-ধারণার লক্ষণ দেখা দিলে তার মা বিশ্বাস করেন, তার পুত্র স্বয়ং শিব অবতাররূপে জন্মগ্রহণ করেছেন।
কলকাতায় শিক্ষাজীবন শেষ করার আগেই তিনি যোগসাধক এবং দার্শনিক রামকৃষ্ণ পরমহংসের সান্নিধ্যে আসেন। তাই তার মধ্যে দার্শনিক-আধ্যাত্মিক-মানব সেবার দীক্ষা খুব শুরু থেকেই শুরু হয়।
স্বামী বিবেকানন্দ প্রচুর বই পড়তেন। দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্য বিষয়ে বই পড়ায় তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। বেদ, উপনিষদ্, ভাগবদগীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পাঠেও তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। এছাড়া তার সময় কাটতো হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিয়ে, খেলাধুলা ও সমাজসেবামূলক কাজ করে। তিনি মানবধর্মের মহান আদর্শে বিশ্বাস করতেন। রাজা রামমোহন রায়ের বেদান্তবিষয়ক গ্রন্থাদি পাঠ করে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হন।
জেনারেল অ্যাসেম্বলি’জ ইনস্টিটিউশনে (অধুনা স্কটিশ চার্চ কলেজ, কলকাতা) পড়ার সময় নরেন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যা, পাশ্চাত্য দর্শন ও ইউরোপীয় ইতিহাস অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি ছাত্রজীবনে বহু দার্শনিক-সাহিত্যিকদের বই পড়েছিলেন। ডেভিড হিউম, জর্জ ডব্লিউ. এফ. হেগেল, আর্থার সোফেনহায়ার, অগাস্ত কোঁত, জন স্টুয়ার্ট মিল ও চার্লস ডারউইনের রচনাবলি তিনি আগ্রহভরে পাঠ করেন। দার্শনিক হারবার্ট স্পেনসারের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের প্রতি তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। জানা যায়, সে সময়ে স্পেনসারের সঙ্গে তার চিঠিপত্র বিনিময়ও হত। হার্বার্ট স্পেনসারের রচিত ‘এডুকেশন’ (১৮৬১) বইটি তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। পাশ্চাত্য দার্শনিকদের রচনাবলি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ ও বাংলা সাহিত্য নিয়েও চর্চা করেন।
জেনারেল অ্যাসেম্বলি’জ ইনস্টিটিউশনের প্রিন্সিপাল উইলিয়াম হেস্টি লিখেছেন,
‘নরেন্দ্র সত্যিকারের মেধাবী। আমি বহু দেশ দেখেছি, কিন্তু তার মতো প্রতিভা ও সম্ভাবনাময় ছাত্র দেখিনি। এমনকি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দর্শনের ছাত্রদের মধ্যেও না।’
একবার মেরঠে থাকাকালে বিবেকানন্দ স্থানীয় লাইব্রেরি থেকে বই আনাতেন। আবার পরের দিনই পড়ে তা ফেরত দিয়ে দিতেন। এত দ্রুত বই ফেরত দেওয়ার ঘটনা লাইব্রেরিয়ানকে ভাবায়। লাইব্রেরিয়ান একদিন বিবেকানন্দের কাছে জানতে চান তার এই বই ফেরতের রহস্য। তখন স্বামী বিবেকানন্দ লাইব্রেরিয়ানের সমস্ত ধারণা পাল্টে চমকে দেন একেক বইয়ের একেকটি ঘটনা তুলে ধরে!
স্বামী বিবেকানন্দের বোধশক্তি প্রখর ছিল। এই শক্তি যে শুধু বিধাতা তাকে বিশেষভাবে অর্পণ করেছে বিষয়টি ঠিক তা নয়। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এই ক্ষমতা সুপ্তাবস্থায় রয়েছে। কিন্তু আমরা অনেকেই আমাদের মস্তিষ্কের শক্তি সম্পর্কে অবগত নই, আর তাই আমরা পিছিয়ে পড়ি। কীভাবে সম্ভব এরূপ জ্ঞান লাভ করা?
- একটি কাজ করার সময় সেই একটা কাজেই সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে। অন্য যেকোনো কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে নিজেকে।
- ধ্যান মানুষের মনকে শান্তি দেয়। গভীরভাবে ধ্যান করলে মানসিক শক্তি ও স্বাস্থ্য বৃদ্ধি পায়।
- গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় এবং অবাঞ্ছিত বিষয়কে তুচ্ছজ্ঞান করতে হবে।
- কৌমার্যের অনুশীলন মনকে শান্ত করবে এবং অন্য যেকোনো বিষয়ে মনোনিবেশ করতে সাহায্য করবে।
তৃতীয় নয়নের অধিকারী স্বামী বিবেকানন্দ এই সকল বিষয় মেনে চলতেন বলেই তিনি অসীম জ্ঞানের অধিকারী হতে পেরেছেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তিনি সবটুকুই আয়ত্ত্ব করেছিলেন নিজ ধৈর্য্যগুণে, অনুশীলনে, চর্চায়। চাইলে আপনিও পারেন কিন্তু!
স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কিত সকল বই দেখতে এবং পেতে