শায়লা বেগম বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ। জ্বরে কাতরাচ্ছেন। পাশের রুমে ছেলে রুহিন মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। মায়ের গোঙানি তার কানে ভেসে এলেও খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। রুহিনের হঠাৎ মনে হলো ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কী নিয়ে দেওয়া যায়? আবারো মায়ের গোঙানি শুনতে পেল সে। ব্যাস! স্ট্যাটাস দেওয়ার বিষয় খুঁজে পেয়ে গেল। স্ট্যাটাসে মায়ের অসুস্থতার কথা জানিয়ে সবাইকে দুআ করার অনুরোধ জানাল। মুহূর্তেই লাইক, কেয়ার, স্যাড রিয়েক্টের সংখ্যা বাড়তে লাগল। অগণিত কমেন্টও পড়ল। পোস্টটি দেখে তার ফ্রেন্ডলিস্টের সবাই ভাবল, আহা! কী লক্ষ্মী ছেলে। মায়ের জন্য কতই না ভাবে!
এদিকে শায়লা বেগম কাতরাচ্ছেন আর মনে মনে ভাবছেন, ছেলেটা পাশের রুমে কী করছে? আমার কাছে আসছে না কেন? ইশ, পাশে এসে যদি একটু বসত! জ্বরের তাপে পুড়ে যাওয়া কপালে হাতটি রেখে যদি বলত, আম্মু তোমার কি খুব খারাপ লাগছে? তাহলেও তো ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে উঠত। ভাবতে ভাবতেই গাল বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু বালিশ স্পর্শ করল।
কথায় বলে, বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। প্রযুক্তির অভিশাপে শায়লা বেগমের ঘটনাটির মতো এমন অসংখ্য করুণ ঘটনার জন্ম নিচ্ছে, যা কোনোভাবেই কারো কখনো কাম্য ছিল না। অথচ সন্তানের হাতে এ প্রযুক্তি হয়তো শায়লা বেগম নিজেই তুলে দিয়েছিলেন।
না, প্রযুক্তির গুটিকয়েক উপকারী দিকও রয়েছে। যেমন : যেসব শিশুরা প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত তারা সাধারণত অন্য শিশুদের তুলনায় অধিক তথ্য জানে। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষামূলক গেমস তাদের লেখাপড়ার উন্নতি ঘটায়। এসব গেমস শিশুর মনে এক ধরনের প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি করে। এর ফলে সে বাস্তব-জীবনে যতই পরীক্ষায় বা প্রতিযোগিতার মুখে পড়ুক না কেন—তা সুন্দরভাবে পরিচালনা করে। এ ছাড়া অনলাইনে শ্রেণির পাঠদানের বিষয়টিও উপকারের অন্যতম একটি অংশ। কিন্তু প্রযুক্তি-আসক্তির উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি।
প্রযুক্তির অতি ব্যবহার তৈরি করতে পারে নানান শারীরিক সমস্যা
শুধুই কি সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়? শিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির কারণও এ প্রযুক্তিই। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব শিশুরা প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত তারা বিশেষ করে চোখের সমস্যায় ভোগে। এ ছাড়া মাথাব্যথা, পিঠব্যথাসহ অসংখ্য শারিরীক সমস্যায় ভোগার ঝুঁকি থাকে। এসব প্রযুক্তির সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত সময় কাটানোর ফলে তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফলে সে দ্রুতই মোটা হতে থাকে। এছাড়া প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার একটি শিশুর প্রতিদিনের খাবারের প্রতিও অরুচি তৈরি করে।
তৈরি হয় যোগাযোগের দুর্বলতা
প্রযুক্তির অধিক ব্যবহারের ফলে একটি শিশু সামাজিকভাবেও অনুপযোগী হয়ে উঠতে পারে। বিশেষজ্ঞদের দাবী, যেসব শিশু সারাদিন নিজ নিজ ডিভাইসে ব্যস্ত থাকে—এরা সাধারণত অন্য মানুষের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টিতে দুর্বল হয়। পরিবারের বাইরে কারো সঙ্গে ইন্টারনেটে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যতটা স্বাভাবিক আচরণ করে, ততটা স্বাভাবিক আচরণ বাস্তব জীবনে করতে পারে না।
শিশুর কল্পনাশক্তি সীমিত হয়ে আসে
আমরা অনেকেই বাচ্চাদের বিনোদনের মাধ্যম হিশেবে টিভিতে কার্টুন দেখতে বলি। টিভিতে কার্টুন দেখা শিশুদের সাময়িক আনন্দ দিলেও স্থায়ীভাবে অনেক ক্ষতি করে। একনাগাড়ে টিভিস্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখ দিয়ে পানি পড়া, কম দেখা, মাথাব্যথাসহ বিভিন্ন প্রকার সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। এ ছাড়া টিভিতে কার্টুন দেখার ফলে শিশুদের কল্পনাশক্তির খুব একটা উন্নতি ঘটে না। কারণ- কার্টুনের ঘটনাটি সে দেখে ফেলার কারণে তাকে আর কল্পনা করে দেখে নিতে হয় না। ফলে টিভিতে কার্টুন দেখার মধ্যে ক্ষতির দিকটাই বেশি।
আবার অনেক সময়ই, আনন্দের সঙ্গে সময় পার করার জন্য শিশুদের হাতে ইউটিউব ভিডিও ধরিয়ে দিই আমরা। প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি তার মূলত এখান থেকেই শুরু হয়। টিভি দেখলে যে যে ক্ষতি হয় ঠিক একই ক্ষতি ইউটিউব ভিডিও দেখার মধ্য দিয়েও হতে পারে। এছাড়া বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকর এমন অনেক ইউটিউব ভিডিও তার সামনে চলে আসতে পারে। এগুলো দেখার মধ্য দিয়ে মানসিক অনেক সমস্যা ঘটতে পারে তাদের।
শিশুদের হাতে তুলে দেয়া যায় বই
প্রযুক্তির এত এত ক্ষতিকর দিক জানার পর অভিভাবকগণ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, এর বিকল্প হিসেবে আমরা তাদের হাতে কী তুলে দিতে পারি? উত্তরটি খুব একটা কঠিন নয়। প্রযুক্তির বিকল্প হিশেবে শিশুদের হাতে রঙিন বই তুলে দেওয়া যায়। কেননা, তাদের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সামান্য ভালো দিক থাকলেও এর ক্ষতিকর দিকটাই বেশি৷ কিন্তু বইয়ের ভালো দিক ছাড়া কোনো ক্ষতিকর দিক নেই। তবে বই নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখা দরকার, ঠিক কোন ধরনের বই তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে।
আরও পড়ুন- শিশুদের বই কিনে দেয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন
কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটায় বই
পাঠ্যবইয়ের বাইরে বিভিন্ন শিশু-কিশোর উপযোগী রঙিন বই বাচ্চাদের কল্পনা শক্তি বৃদ্ধি করে। এসব বই পড়ার মধ্য দিয়ে তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবতে শেখে, কল্পনা করতে শেখে। এছাড়া বই পড়ার মধ্য দিয়ে তারা অনেক নতুন নতুন তথ্য জানতে পারে—যা তাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে।
বই মানসিক চাপ কমায়
মানসিকভাবে অনেক উপকার করতে পারে বই। সামাজিক হোক, পারিবারিক হোক—বিভিন্ন কারণে শিশুদের মস্তিস্কে যদি কখনো কোনো উদ্দীপনা বা উত্তেজনার সৃষ্টি হয় তবে বই পড়ার মাধ্যমেই তা দূর করা সম্ভব। কারণ বইয়ের মধ্যে বাচ্চারা যতক্ষণ ডুবে থাকে ততক্ষণ তাদেরকে কোনো জাগতিক দুঃশ্চিন্তা ছুঁতে পারে না।
বই দিতে পারে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
অভিভাবকগণ হয়তো কাজের চাপে বাচ্চাদের নিয়ে খুব একটা ঘুরতে যেতে পারেন না। ফলে তাদেরকে এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। ভ্রমণের যে আনন্দ সেটার কিছুটা হলেও দিতে পারে বই। কারণ বইয়ের ভেতর যে জগৎ বা স্থানের কথা বর্ণনা করা হয়ে থাকে সেটি পড়ার মাধ্যমে এক ধরনের সংযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়। তাতে করে তারা নতুন কিছুর সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। বই পড়ার মাধ্যমে কল্পনাশক্তি দিয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যাওয়া সম্ভব।
স্মরণশক্তি বৃদ্ধিতে বইয়ের চেয়ে ভালো বিকল্প নেই
শিশুদের স্মরণ শক্তিও বৃদ্ধি করতে পারে বই। কেননা, তারা যখন কোনো গল্প পড়ে সেই গল্পের কোনো চরিত্র বা ঘটনা তাদেরকে হয়তো আলোড়িত করে, ভাবায়। তাদের ব্রেনে সেই ভাবনা বার বার অনুরণিত হয়। এর ফলে ব্রেনের স্মৃতিশক্তি বাড়তে থাকে৷ পাঠ্যবইয়ের পড়া মনে রাখার ক্ষেত্রে এটি অনেক সাহায্য করে।
মনোযোগ বৃদ্ধিতে বইয়ের চেয়ে ভালো দাওয়াই আর কী?
বাচ্চারা নতুন নতুন শব্দের সঙ্গেও পরিচিত হতে পারে বই পড়ার মধ্য দিয়ে৷ ফলে ব্যক্তিজীবনে তারা হয়ে উঠতে পারে অনেক আত্মবিশ্বাসী। তাছাড়া একাগ্রতা বৃদ্ধি করে মানসিক প্রশান্তি দিতে পারে বই। কারণ- কোনো গল্প পড়ার সময় তখন পূর্ণ মনোযোগ সে বইয়েই থাকে। যে কারণে একাগ্রতা তৈরি হয় এবং গল্পটি উপভোগ করার মধ্য দিয়ে মানসিক প্রশান্তিও আসে।
আত্মসম্মান বোধ বৃদ্ধি করে
আত্মসম্মানবোধও তৈরি করতে পারে বই। বই পড়ে বাচ্চারা ভালোমন্দ মানবিক গুণগুলোর মূল্য বুঝতে শেখে, তাই নিজের এমন একটা আত্মসম্মানবোধ তৈরি হয়, যেটা অন্যভাবে এতটা হতে পারে না ।
বই পাঠে নেমে আসতে পারে শান্তির ঘুম
প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে অনেক শিশুর ঘুম উধাও হয়ে যায়। ৩-৪ ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারে না। পারলেও সেটি খুব একটা স্বস্তির হয় না। অথচ গবেষণায় উঠে এসেছে, একটি ভালো বই পড়া র ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলো শান্তভাবে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করে৷ ফলে গাঢ় ঘুমের প্রবণতা বেড়ে যায়।
নিয়মিত বই পড়লে বাচ্চাদের মনে সহানুভূতি তৈরি হয়। গল্পের চরিত্রের বিভিন্ন ঘটনায় তাদের সহানুভূতি কাজ করে। চরিত্রের সুখ, দুঃখ তাদেরকে আলোড়িত করে, ভাবায়। ফলে শিশুদের ভেতর সহানুভূতির চর্চাটা ক্রমেই বাড়তে থাকে। তাই আসুন, সচেতন অভিভাবক হিশেবে সন্তানের দিকে সুনজর দিই এবং সিদ্ধান্ত নিই আধুনিক শিশুর হাতে কী তুলে দেব—প্রযুক্তি, নাকি বই?
comments (0)