সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর বলতেই একসময় বুঝতাম, অনেকগুলো হিজিবিজি বাটনসহ একটি বড় আকৃতির ফোনের মতো একটা বস্তুকে। কিন্তু বড় হতে হতে বুঝলাম, ক্যালকুলেটর যে যোগ-বিয়োগের বাইরেও বহু জিনিসের গাণিতিক সন্নিবেশ ঘটাতে পারে, তার দুর্দান্ত উদাহরণ হলো এই সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর। পৃথিবীজুড়েই সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটরে এগিয়ে আছে CASIO নামের কোম্পানিটি। ১৯৪৬ সালে জাপানের টোকিওতে শুরু করে ইলেক্ট্রিক প্রোডাক্টের এই কোম্পানি এখন ছড়িয়ে গেছে বিশ্বজুড়ে। আর এতেই যেন বিপত্তি! সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে আছে Casio নামেরই অসংখ্য নকল প্রোডাক্ট। উন্নত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের এই যুগে যেহেতু মাধ্যমিক থেকেই শিক্ষার্থীরা ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে থাকে, তাই নকল ক্যালকুলেটরে বাজার সয়লাব হওয়াও বেশ সহজ। দেখতে প্রায় হুবহু একই রকম ক্যালকুলেটরের মধ্যে সহজ এবং নকল বাছাই করাটা বেশ সমস্যার। আর তাই আজকের এই লেখায় থাকছে ক্যাসিওর আসল সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর চেনার কিছু ‘নিনজা টেকনিক’।
তবে তার আগে একটা কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন। আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরাই ক্যালকুলেটরের সবগুলো ফিচার নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। ‘একটা সামান্য অংক করতে ক্যালকুলেটর লাগে নাকি?’ এরকম কথা আমাদের আশেপাশে শোনা যায় অহরহ। তবে ক্যালকুলেটরের সঠিক ব্যবহার জানা থাকলে, ক্যালকুলেটর দিয়েই করা যায় দুর্দান্ত সব কাজ। আমরা যদি ক্যাসিওর (Casio) জনপ্রিয় FX-991EX মডেলের ক্যালকুলেটরকে সামনে রেখে চিন্তা করি, তবে দেখতে পাবো শুধু এই মডেলের একটি ক্যালকুলেটরেই ফাংশন রয়েছে ৫৫২টি!
৯৯১ ইএক্সের মডেলের এই ক্যালকুলেটরের সকল দারুণ ফিচারের মাঝে একটি হচ্ছে ‘মাল্টিলাইন ফন্ট সিস্টেম’। এর ফলে আপনি একই সাথে একাধিক ক্যালকুলেশন করতে পারবেন এবং একই সাথে ফলাফল দেখতে পারবেন। এছাড়া এতে রয়েছে ‘কিউআর কোড জেনারেটর’ পদ্ধতি। যে কোন ধরনের ক্যালকুলেশন আপনি কিউআর কোড তৈরি করে স্মার্টফোনের ‘ক্যাসিও এডু প্লাস’ এপ্লিকেশন দিয়ে বিস্তারিত দেখতে পারবেন। চাইলে আপনি ক্যালকুলেশনটি সংরক্ষণ (Save) করে রাখতে পারবেন এবং সকলের সাথে লিংক (link) তৈরির মাধ্যমে শেয়ার করতে পারবেন। এই ক্যালকুলেটরের সাহায্যে কমপ্লেক্স নাম্বার, বিভিন্ন ঘাত, ম্যাট্রিক্স, ভেক্টর, স্ট্যাটিস্টিকস, ডিস্ট্রিবিউশন, স্প্রেডশিট, টেবিল, ইনইকুয়েলিটি ও রেশিও সম্পর্কিত যে কোন গাণিতিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু এই দুর্দান্ত ফাংশনগুলোর বেশিরভাগই আপনি উপভোগ করতে পারবেন না, যদি আপনি সঠিক ও আসল ক্যালকুলেটর না কেনেন। কিংবা আসল ক্যালকুলেটর চেনার উপায় না জানেন। তবে চলুন জেনে আসা যাক, কিভাবে আসল ক্যালকুলেটর চিনবেন।
ক্যালকুলেটরের স্ক্রিনে ‘CASIO’ শব্দটি ভেসে উঠবে
প্রথমত, আসল ক্যালকুলেটর চেনার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো- ক্যাসিওর নামটি ইংরেজিতে ক্যালকুলেটরের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা। যখন আপনি ক্যালকুলেটরটি বন্ধ করার জন্য (Shift+off) বোতাম চাপবেন, তখনই আসল ক্যালকুলেটরের স্ক্রিনে- CASIO শব্দটি ভেসে উঠবে। তারপর ক্যালকুলেটরটি বন্ধ হবে। অপরদিকে নকল ক্যালকুলেটরে কোনোভাবেই আপনি CASIO শব্দটি ভেসে উঠতে দেখবেন না।
ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি বা Diagonostic Method
দ্বিতীয়ত, এই পদ্ধতিকে বলা হয় ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি বা Diagonostic Method। যদি আপনি ক্যালকুলেটরের ডায়াগনস্টিক মুডটি চালু করেন তবে সেখানে বেশ কিছু অপশন স্ক্রিনে দেখা যায়। আপনি সেখানে দেখানো কী-গুলো (Key) চাপ দিলে স্ক্রিনের ওটুকু অংশ কালো হতে দেখা যাবে। একটু জটিল মনে হচ্ছে কী? চলুন আরো সহজভাবে বোঝার চেষ্টা করি।
আপনি আপনার Casio কোম্পানির Fx-991EX মডেলের ক্যালকুলেটরটি হাতে নিন। সেখান থেকে একই সাথে তিনটি বোতাম চাপুন। যথাক্রমে শিফট (Shift), সংখ্যায় চাপুন 7 (সাত) এবং ক্যালকুলেটরটি চালু করার বোতাম অর্থাৎ On অপশনটি চাপুন। সহজভাবে বলতে গেলে-
Shift+7+On
হ্যাঁ। Shift+7+On ক্লিক করলে উপরে দেখানো ছবিটির মত স্ক্রিনে লেখা উঠবে। তখন ডায়গনস্টিক মুডে কাজ করার জন্য ক্যালকুলেটর থেকে 8 (আট) সংখ্যাটি চাপতে হবে। তাহলেই স্ক্রিনে ডায়গনস্টিক মুডের বিভিন্ন লেখা দেখা যাবে। সেগুলোর প্রত্যেকটিতে আলাদা আলাদা করে কী (key) দেয়া থাকবে। সে অনুযায়ী কী (key) চাপলেই স্ক্রিনের অংশটুকু কালো হয়ে যাবে। অর্থাৎ ঠিকঠাকভাবে ডায়াগনস্টিক অংশগুলো কাজ করবে। নিচে দুটো ছবির মাধ্যমে ব্যাপারটিকে আরো সহজভাবে বোঝা সম্ভব।

এখানে প্রত্যেকটি লেখার বাম পাশে একটি করে কী-ওয়ার্ড (Key-word) রয়েছে। যেমন [1], [2] অথবা [log], [Shift] ইত্যাদি। যখন এই কী-ওয়ার্ডের যে কোনো একটিতে ক্লিক করা হবে, তখন স্ক্রিনের ঐ অংশটুকু কালো রঙ দিয়ে চিহ্নিত করে দেয়া হবে। ধরা যাক, এখানে [1] বোতাম চাপা হলো- তাহলে সেইটুকু অংশ সম্পূর্ণরূপে কালো রঙে চিহ্নিত করতে দেখা যাবে।

এভাবে যদি একে একে কী-ওয়ার্ডগুলো দেখে বোতাম চাপা হয়। তবে সবগুলোই কালো হতে শুরু করবে। ধরা যাক, ডানপাশের প্রথম চারটি বোতাম চাপা হলো। তবে সবগুলো চিহ্নিত হবে।

কিন্তু নকল ক্যালকুলেটরে কোনোভাবেই এটি করা সম্ভব নয়। বরং কিছু ক্ষেত্রে ডায়াগনস্টিক মুড চালু করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ নকল ক্যালকুলেটরে এই ফাংশন থাকবে না।
সোলার প্যানেল পদ্ধতি
তৃতীয়ত, সোলার প্যানেল পদ্ধতির সাহায্যেও খুব সহজেই অনেকগুলো ক্যালকুলেটর থেকে আসলটি বের করা সম্ভব। আমরা জানি, সাধারণত সবগুলো সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটরেই সূর্যের আলো থেকে শক্তি সংগ্রহ করে চলার মত সোলার প্যানেলের একটি ছোট অংশ ক্যালকুলেটরের উপরে জুড়ে দেয়া হয়। যাতে এটি ব্যাটারির পাশাপাশি সূর্যালোকের শক্তিও সমানভাবে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু নকল ক্যালকুলেটরগুলোতে বাহ্যিকভাবে সোলার প্যানেলের উপস্থিতি থাকলেও সেটি কোনো কাজ করে না, অর্থাৎ নিস্ক্রিয় থাকে। প্রশ্ন আসে, সেটা বুঝবো কী করে?
সোলার প্যানেলের সাথে মূল সার্কিটের যোগসূত্র
আপনি চাইলেই ক্যালকুলেটরের পেছনের অংশ খুললে দেখতে পাবেন নকল ক্যালকুলেটরের সোলার প্যানেলের সাথে মুল সার্কিটের কোনো যোগসূত্র নেই। কিন্তু দোকানে ক্যালকুলেটর কেনার সময় তো আর সেটির ভেতরের সার্কিট দেখার সুযোগ থাকবে না। তাছাড়া আপনি যদি আমার মতো এসব কাজে পারদর্শী না হন, তবে আপনার জন্য রয়েছে পানির মতো সহজ একটি পদ্ধতি। যার মাধ্যমে এক নজরেই আপনি বুঝে যাবেন এটিতে সোলার প্যানেল কাজ করছে কি না!
Bright Dot
আসল ক্যালকুলেটরগুলোর স্ক্রিনের উপরে সর্বডানে একদম কোনায় একটি ছোট আকৃতির কালোবৃত্ত দেখতে পাওয়া যায়। এটাকে ইংরেজিতে Bright Dot বলতে পারি। দেখতে কিছুটা (.) এরকম। এটা মুলত সূর্যের চিহ্ন। অর্থাৎ সোলার প্যানেলের সাহায্যে এটি বর্তমানে শক্তি নিয়ে চলছে। আপনি যদি সোলার প্যানেলটি আঙুল দ্বারা পুরোপুরি ঢেকে দেন তবে দেখবেন তৎক্ষনাত চিহ্নটি উধাও হয়ে যাবে। অর্থাৎ সোলার প্যানেল ঢেকে থাকার কারণে শক্তি নেয়া যাচ্ছে না। এটি খুব সহজেই আপনি বুঝতে পারবেন। কিন্তু নকল ক্যালকুলেটরে কোনভাবেই এরকম কোন ‘ব্রাইট সাইন’ অথবা কালো আকৃতির ডট চিহ্ন খুঁজে পাবেন না।
(QR) কোড পদ্ধতি
চতুর্থত, আপনি কিউআর (QR) কোড তৈরির মাধ্যমে আসল-নকল নির্নয় করতে পারেন। এই ফাংশনটিকে ক্যাসিওর (Casio) FX-991EX মডেলের ক্যালকুলেটরের পক্ষে একটি স্বতন্ত্র ফাংশন বলা যেতে পারে। সহজভাবে বললে, আপনি যদি কোনো ইকুয়েশন দিয়ে তার ফলাফল বের করেন, তবে সেটি বের হলেও মূলত অঙ্কন চিত্র বের করা সম্ভব না। কারণ এটিতে গ্রাফিক্সের কোন কিছু দেখা যায় না। কিন্তু সেক্ষেত্রে Casio কোম্পানির Fx-991EX মডেলের ক্যালকুলেটরটি আপনাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি কিউআর কোড (QR Code) তৈরি করে দেবে, যেটি স্ক্যান করলে আপনাকে তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে নিয়ে আপনার ইকুয়েশনটির একটি অঙ্কিত চিত্র দেখানো হবে। এটি যে কোনো শিক্ষার্থীর জন্য দুর্দান্ত একটি ফিচার, যা আসল ক্যালকুলেটর ছাড়া সম্ভব নয়।
এটি কিভাবে করবেন?
খুবই সহজ পদ্ধতি। প্রথমে ক্যালকুলেটরের মধ্যে থাকা ইকুয়েশনের বোতামটি চাপবেন। এতে করে বেশ কিছু ইকুয়েশনের অপশন স্ক্রিনে দেখাবে। ধরা যাক, আপনি Simul Equation পছন্দ করলেন। এবং ইচ্ছেমত ভ্যারিয়েবলের সংখ্যা দিয়ে সেগুলোতে ভ্যারিয়েবলের মানগুলো দিলেন। তারপর ফলাফলের বোতাম (=) চাপলে সরাসরি x এবং y এর মান ফলাফল হিসেবে দেখানো হবে। এখন আপনি চাচ্ছেন এটির বিস্তারিত রূপ দেখতে। তখন শুধুমাত্র যথাক্রমে শিফট এবং অপশন (Press Shift+Option) বোতামটি চাপলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্ক্রিনে একটি কিউআর কোড (QR Code) দেখাবে। আপনি চাইলে যে কোনো স্ক্যানার মেশিন অথবা আপনার স্মার্টফোনে কোনো একটি কিউআর স্ক্যানার অ্যাপের মাধ্যমে কোডটি স্ক্যান করতে পারবেন। কোডটি আপনাকে Casio এর নিজস্ব ওয়েবসাইটে নিয়ে যাবে। আর সেখানেই আপনি আপনার প্রদান করা ভ্যারিয়েবলগুলো অর্থাৎ গণিতের সমাধানের পাশাপাশি বিস্তারিতভাবে একটি অঙ্কন করা চিত্র দেখতে পাবেন। খুব সহজেই আপনি ধরতে পারবেন কোনটি কোন বিন্দুতে ছেদ করেছে।

গুগল প্লে স্টোর কিংবা অন্য কোনো জায়গা থেকে স্ক্যান করার কোনো অ্যাপ ব্যবহার করে স্মার্টফোনটি এই কিউআর কোডের উপর ধরলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোডটি একটি ওয়েবসাইটের লিংকে নিয়ে যাবে। এবং সেখানে প্রদান করা ইকুয়েশনের বিস্তারিত চিত্র দেখানো হবে।

এরকম বেশ কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা খুব সহজেই শুধুমাত্র কয়েকটি বোতাম চেপে Casio এর মত জনপ্রিয় কোম্পানির ক্যালকুলেটরের বিশুদ্ধতা যাচাই করতে পারি। আর হ্যাঁ, যেহেতু এখন পর্যন্ত মাধ্যমিক এমনকি উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষায় এই ক্যালকুলেটরটি নেয়ার ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা নেই, তাই শিক্ষার্থীদের উচিত আসল ক্যালকুলেটরটি সংগ্রহ করবার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা। টাকা দিয়ে নকল জিনিস কেনার তো কোন মানে হয় না, তাই না?
ক্যাসিওর সবগুলো ক্যালকুলেটর দেখতে ক্লিক করুন
1 thought on “কিভাবে চিনবেন আসল ক্যালকুলেটর?”
Good