১.
কেন লিখি? বারবার এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা ভালো। একেকবার একেক উত্তর হবে, পরে পড়ে পুলক মিলবে। ‘কেন খাই?’ জিজ্ঞাসার উত্তর ‘খিদা মেটানোর জন্য’, বা ‘ভালো লাগে’ যেমন হতে পারে, ‘কিছু করার নাই তাই খাই’ বা ‘আমি খেলে আপনার কী?’ এইরকম শ শ উত্তরও হতে পারে। সব উত্তরই ঠিক উত্তর। মানুষ বদলায়, অস্বীকার করলেও। তাই তার কারণ বদলে যায়। যে জন্যে একজন শুরুতে লেখে, পরে অন্য কারণে লেখে, তারপর হয়তো আর কোনো অন্যকারণ তাকে লিখিয়ে নেয়। একই কারণে মানুষ বাঁচে না যেমন, তেমনি লেখেও না। একই কারণে যিনি লেখেন, তিনি সম্ভবত অন্য কারণগুলো নিজেকে এবং অন্যকে জানাতে ভয় পান, যদি লোকে তাকে টলমল স্বভাবের লোক ভেবে বসে, বা যদি ভাবে যে নিজেই একেকসময় একেককথা বলে তার ওপর ভরসা রাখি কী করে। কিংবা হয়তো ঠিক ভয় নয়, হয়তো আগের উত্তরপত্রগুলো দেখে দেখে নিজেই নিজেকে বুঝিয়ে ফেলেছেন, তারও একটাই স্থির উত্তর থাকতে হবে। নতুবা বিকল্প হিসেবে রসিকতা করে ‘কেন লিখি?’র চালু প্রশ্নটাকে ঠাট্টায় পরিণত করে ফেলতে। যার রসিকতা আসে না, তার সিরিয়াস কথাবার্তা বলাটাই লাভের।
ইফতেখার মাহমুদের সবগুলো বই এখানে
২.
সম্ভবত আমি ভুলে যেতাম, তাই লিখে রাখতে শুরু করি। অনর্গল কথা বলতাম একসময়। যা মাথায় আসত, তাই নিয়ে বসে বসে ভাবতাম। চিন্তা করে করে একটার সাথে আরেকটার মিল, অমিল, চির, যোগ এইসব বের করতাম। বলতামও সেসব বন্ধুদের। অবিরাম কথা বলার জন্য আমার বদনামও হয়েছিল খানিক। যাই হোক, স্বভাব আমাকে থামতে দিত না। কথা বলার একটা হতাশার দিক আছে। ক্লান্তির পাশাপাশি শ্রোতা খুঁজে খুঁজে বের করাটাও শ্রমের। গল্প করার জন্যে এখানে ওখানে যেতে হয় । তারওপর দেখলাম, কথাসব হারিয়ে যাচ্ছে। পরে মনে করতে পারতাম না। তখনই সম্ভবত লিখে রাখা শুরু করি। গুহামানবসুলভ কর্ম। পরে যেন মনে করতে পারি।
শুরুর বোধকরি আরও একটা কারণ আছে। লেখক কবি এরা আমার প্রিয় ছিলেন। আরও অনেকের মতোই পড়তে ভালো লাগত আমার। এদের মতো হওয়ার একটা ইচ্ছে হয়তো হত। সেই কারণেও হতে পারে, লিখতে শুরু করি। মনে আছে, সতেরো বছরের দিকে আমি আবেগাক্রান্তের মতো নিরুপায় হয়ে লেখা শুরু করি। সম্ভবত, সেসব এতো ভালো লাগতে থাকে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনাকে অগ্রাহ্য করে ফেলার মতো অবিমৃশ্য হয়ে উঠি সেসময় থেকেই।
সবসময় কিন্তু কথা বলাও যায় না। লোকে ঘুমায়। কাছে থাকে না। যে কথা বলে তারও ঘুম আছে। কিন্তু লেখা জেগে থাকে সারাক্ষণ, কখনো সে ঘুমিয়ে পড়ে না। লিখে তাদের পাঠিয়ে দেয়া যায়। লেখা নিজেদের সময়ে পড়ে নিতে পারেন তারা। অন্যকেও দিতে পারে পড়তে। তো আমি লেখা অব্যহত রাখলাম।
আমি যা কিছু ভাবি, তা হারানোর হাহাকার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য, লিখে রাখা ছাড়া আমার অন্য উপায় ছিল না।
দেখুনঃ ইফতেখার মাহমুদের কথামালা
৩.
লেখককে শুধুমাত্র লেখক, এই কারণে উন্নত শ্রেণি মনে করাটা ঠিক হবে না হয়তো। মানুষের কদর্যতর হওয়ার বিস্ময়কর ক্ষমতাটি লেখকেরও থাকতে পারে। সেটা স্বাভাবিকও। লেখার কাজটির পেছনে সবসময় মহত্তর কোনো কারণ থাকবেই এই অনুমান থেকে সরে আসা ভালো। ঐ যে কথাটা আছে না, প্রত্যেক কাজের পেছনে একটা করে ‘গুড রিজন’ আছে, আর আছে একটা করে ‘রিয়াল রিজন’ । ‘ভালো কারণ’ আর ‘আসল কারণ’। এই আসল কারণ বিষয়টা মজার, সবসময় সবাইকে বলা যায় না। গুড রিজনটা চলনসই জিনিস, বুদ্ধি খাটিয়ে এটা বানানো হয়, বেমানানও না, লোকে বিশ্বাস করে। আমাদের সামনে সবসময় গুড রিজন এসে হাজির হয়। অন্যের রিয়াল রিজন আমাদের ভেবে ভেবে বের করতে হয়।
৪.
একজন লেখকের লেখার রিয়াল রিজন কী কী হতে পারে?
– সে আর কিছু পারে না, ভাষাটা জানে, জীবন অভিজ্ঞতা সবার মতো তারও আছে, সেসবই সে লেখে, লিখতে পারে, অন্যকিছু পারে না, পারতে চায়ও না, তাই লেখে।
– লিখে সে সবাইকে দেখাতে চায়, সেও পারে, কিংবা দেখাতে চায়, দেখো এইভাবেও দেখা যায়, কিংবা বলে, দেখে যাও, তোমরা যা দেখো তা ভুল, আসল এখানে আছে (আসলে সব মানুষই আসল, যে লেখে সে বেনিফিট নিতে চায়, নিজেকে একটু বেশি আসল মনে করে।)।
– লিখে সে লেখক নাম চায়। লেখকেরা তার প্রিয়, সেও অন্যের প্রিয় হতে চায়।
– কিংবা সে লেখে কারণ সে লিখতে পারে। লোকে তার লেখা ভালোবাসে। চারপাশ আমাদের নির্মাণ করে। একজন এজন্য তো লিখতে পারে, কারণ তার চারপাশ তাকে লিখতে অনুরোধ করে। শ্রদ্ধা করে। মমতা ভালোবাসায় লেখা পড়ে। তাই সে লেখা শেষ করে নতুন লেখা লেখে।
– হয়তো টাকা পাওয়ার জন্যে লিখে চলে। জীবন আছে, যার যাপন আছে। কড়ি দিয়েই কিনতে হয়।
– খুব সহজ কথা, সে হয়তো আসলে কথা বলতে পারে না বা চায় না, প্রকাশের জন্য সে লেখাকে বেছে নিয়েছে। লেখে কারণ সে প্রকাশিত হতে চায়। জীবধর্ম।
– লিখতে লিখতে লেখক জানতে পারেন, নিজেকে আর নিজের ভেতরের জীবন, দুনিয়া- এইসব দেখার নিজ শক্তির সাথে তার পরিচয় হয় লিখে লিখে, তখন এই পরিচয়ের নিত্য নতুন রেখা দেখার আকাঙ্ক্ষায় তিনি লেখা চালিয়ে যান।
আরো দেখুনঃ হুমায়ূন আহমেদের ভেতরে রবীন্দ্রনাথ
আরও দুচারটা কারণ হয়তো লেখা যাবে। অনেকগুলো আলাদা কারণ আপনার হয়তো মনে আসছেও। এইটাই বলছিলাম, নানা কারণে লোকে লেখে, একই কারণে সবসময় লেখে তাও না, আবার মহান কোনো কারণ থাকতেই হবে, সেটাও সবসময়ের সত্য নহে।
কেন লিখি প্রশ্নের মজার মজার উত্তর দিয়েছেন লেখকেরা। জগদীশ গুপ্ত বলেছিলেন, লিখতে বসলে বউ বাজারে পাঠিয়ে দেয় না, তাই তিনি লেখাটা ছাড়তে পারলেন না। বার্নাড শ’র কথাটা হলো, না লিখলে হাত চুলকায় তাই তিনি লেখেন। নীরদচন্দ্র চৌধুরী বলেছেন, ‘বাঘকে জিজ্ঞেস করবেন, কি করে শিকারের ধারণা তার মাথায় এল?’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাটা বোধহয় এরকম যে, যা লেখা ছাড়া অন্য কোনোভাবে যা বলা যায় না, তা প্রকাশের জন্য তিনি লেখেন। হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘নিজের আনন্দের জন্য লিখি’। এসবই হয়তো গুড রিজন। কিংবা রিয়াল রিজন। পাঠকের কাজ, যদি তিনি জানতেই চান কেন লেখেন লেখক, তবে ভেবে বের করা আসল কারণ আসলে কোনটা।
৫.
লিখে অপরের মনকে স্পর্শ করা যায়। কোথাও কোথাও অতলে যাওয়ার অনুমতি মেলে। লিখে একজীবনকে বহু জীবন করা যায়। না থাকার এই পৃথিবীতে লিখে লিখে অনেকখানে কয়েকদিন বেশি থাকার সুযোগ মেলে। সে কারণেও হয়তো অনেকে লেখেন।
লেখা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই লেখক হওয়ার। কেউ কেউ কেন লেখক হতে চায়, লেখককে এই প্রশ্ন না করে, অন্যদের বরং জিজ্ঞেস করা যাক, কেন তারা লেখক হতে চায় না। ব্যস্, তাতেই পরোক্ষভাবে হলেও, উত্তর পাওয়া যাবে কেন একজন লেখক হতে চায়।
লেখার চেয়ে জীবন অনেক বড়। মানুষ জীবনকে বুঝতে চায়। নিজের পতনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। জীবন বাজী রেখে বারবার উত্থানসিঁড়ি রচনা করে। আবার নুয়ে পড়ে অন্য কোথাও। লেখকের হয়তো এইসব নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। নিজের ভেতর দিয়ে সব মানুষের মিলিত বৃহৎজীবনের অন্য এক চেহারা চোখে পড়ে তার। সেই রূপ নিজের দুঃখ-কষ্ট প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বাইরের বিষয়। মাথার ভেতরের সেই জীবনকে খানিক টুকে রাখার জন্যেই বোধহয় লেখেন একজন লেখক।
এক নজরে ইফতেখার মাহমুদ
লিখেছেন ইফতেখার মাহমুদ। জন্ম ৬ মে, ১৯৮০। রংপুরের চতরায়। প্রথম ক’বছর কেটেছে সিলেটে, স্নাতক পর্যায়ের পড়াশুনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। এখন ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক।
শিকড়ে শাখায় মেঘে (২০১৫) প্রথম উপন্যাস, প্রকাশিত অন্যান্য বইগুলো হলোঃ
হে দিগ্বিদিক , হে অদৃশ্য , শিকড়ে শাখায় মেঘে , কথা আর গল্পের জীবন
আরও পড়ুনঃ
নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক কাজুও ইশিগুরোর সঙ্গে কথোপকথন
অ্যালিস মুনরো : ২০১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী