ভাই-বোনের সাথে ঝগড়াঝাঁটি করতে যেয়ে আমরা কতই না উদ্ভট কাজ করে বসি৷ তাই বলে একটা আস্ত গোয়েন্দা উপন্যাস লিখে ফেলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নেওয়া? এইটা কি চাট্টিখানি কথা? ‘কুইন অব ক্রাইম’ খ্যাত আগাথা ক্রিস্টির সাহিত্যজীবন এইরকম এক চ্যালেঞ্জের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধচলাকালীন একদিন তাঁর বড় বোন (মেজ) তাঁকে একটা আস্ত গোয়েন্দা উপন্যাস লেখার চ্যালেঞ্জ জানান। আর সেই চ্যালেঞ্জ লুফে নিয়ে লিখে ফেলেন তাঁর প্রথম বই “দ্যা মিস্টেরিয়াস এফেয়ার অ্যাট স্টাইলস”। অদ্ভুত হলেও সত্যি, তাঁর পরিবার কখনোই তাঁকে লেখাপড়া শেখানোর ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি৷ এমনকি ৮ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর বর্ণ পরিচয়ইও ঘটেনি!

গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়ার হাতেখড়ি। দারুণ আগ্রহ ছিল ক্লাসিক্যাল মিউজিকের প্রতি। কিন্তু মঞ্চভীতি থাকার কারণে পারফর্মেন্সের সময় নার্ভাস হয়ে পড়তেন। অসম্ভব বইপাগল একজন মানুষ ছিলেন। সাধারণ বইপত্র থেকে শুরু করে কাগজের ঠোঙা- হাতের কাছে যা পেতেন তাই পড়ে ফেলতেন।
আগাথা ক্রিস্টি’ই একমাত্র ক্রাইম স্টোরি রাইটার, যার কীনা দুটো গোয়েন্দা চরিত্রই পাঠকের কাছে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চরিত্র দুটো হলো: এরকুল পোয়ারো এবং মিস মার্পল।
গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের লেখিকা আগাথা ক্রিস্টি। পরিসংখ্যান মতে, বই বিক্রির ক্ষেত্রে একমাত্র উইলিয়াম শেক্সপিয়রই তাঁর সমকক্ষ। তাঁর বিক্রিত বইয়ের সংখ্যাটা চোখ কপালে তোলার মতনই, কারণ সংখ্যাটা হল চারশো কোটি! শুধু তা-ই নয়, এ পর্যন্ত প্রায় ১০৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর বই। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় বই, “এন্ড দেন দেয়ার ওয়ার নান” এখন অবধি বিক্রি হয়েছে প্রায় ১০ কোটি কপি।
‘দি মাউসট্র্যাপ’ নামে তাঁর একটি নাটক আছে, যা লন্ডনের বিখ্যাত ‘এম্বাসেডর’স থিয়েটার হল’- ১৯৫২ সালে প্রথম মঞ্চস্থ হয় এবং কোভিড পরিস্থিতির আগে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে এই জায়গায় মঞ্চস্থ হয়ে চলেছিল।
এত এত জনপ্রিয়তা থাকার পরেও তাঁকে একসময় পেতে হয়েছে নিজের বইয়ের সস্তা প্রচারণার অপবাদ। কিন্তু কেন তা কি জানেন? তাহলে শুরু থেকেই বলা যাক।

আগাথার জনপ্রিয়তা যখন একটু একটু করে বেড়ে চলছে, তখন তিনি একজন জীবনসঙ্গী খোঁজার তাগিদ অনুভব করেন। একসময় আর্চিবল্ড নামের একজনকে পেয়েও গেলেন। তিনি ছিলেন ‘রয়েল ফায়িং কোর’-এর এক পাইলট। বিয়ের বারো-তেরো বছরের মাথায় তিনি জানতে পারেন বিশ্বযুদ্ধের সময় পাইলট হিসেবে কাজ করা তার স্বামীর চরিত্রের দোষ আছে। এমনকি শোনা যায়, তিনি নাকি একজন রক্ষিতাও রেখেছেন! সবকিছু মিলিয়েই একটু একটু করে মানসিক অশান্তিতে ভুগতে থাকেন আগাথা।
১৯২৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর, কোনো এক শীতকালের রাত। ঘড়ির কাঁটা ঠিক তখন ৯টায় এসে থেমেছে। আগাথা তাঁর প্রিয় আর্মচেয়ার ছেড়ে চলে গেলেন তাঁর সাত বছরের মেয়ে রোজালিন্ডের ঘরে৷ বার্কশায়ারের বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে সন্তপর্ণে নামলেন তিনি, যাতে তাঁর প্রস্থান কেউ টের না পায়৷ ঘুমন্ত মেয়েকে দেখে নিজের প্রিয় গাড়ি মরিস কাউলিতে চড়ে একরকম অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। সেই যে গেলেন, ১১ দিন পার হয়ে গেলেও তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
তাঁর এই আকস্মিক অন্তর্ধানের এতদিন পেরিয়ে যাওয়ার পর রাষ্ট্রের উপরমহলসহ অনেকের টনক নড়লো। আগাথাকে খুঁজে বের করার জন্য প্রায় হাজারখানেক পুলিশ নিয়োজিত করা হলো। এছাড়াও তাঁর শত শত ভক্ত-অনুরাগীও প্রিয় লেখিকাকে খুঁজতে ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়লো। এমনকি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো ব্যক্তিকে খোঁজার জন্য উড়োজাহাজও ব্যবহৃত হলো! বসে ছিলেন না তাঁর সমসাময়িক ব্রিটেনের দুই গোয়েন্দা ঔপন্যাসিক শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এবং লর্ড পিটার উইমসি সিরিজের রচয়িতা ডরোথি সেয়ার্সও! তাঁরাও তাদের অপরাধ বিষয়ক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আগাথার হদিশ পাওয়ার চেষ্টা চালাতে লাগলেন।
স্যার আর্থার কোনান ডয়েল যেমন গুপ্তবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে রহস্যের সমাধানে অতিপ্রাকৃত শক্তির সাহায্য নেয়ার চেষ্টা শুরু করলেন, অন্যদিকে বাস্তববাদী ডরোথি রহস্যের সমাধানে ঘটনাস্থল একদম চষে বেড়ালেন একটু হিন্টের আশায়। কিন্তু তাঁরা দুজনই চরম ব্যর্থ হলেন।
হোম সেক্রেটারি উইলিয়াম জয়নসন হিকস পুলিশবাহিনীর প্রতি আহবান জানালেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেন লেখিকাকে খুঁজে বের করা হয়।
যে গাড়িটি নিয়ে আগাথা চলে যান, সেই গাড়িটি খুঁজে বের করতে পুলিশের খুব বেশি সময় লাগল না। গিল্ডফোর্ডের কাছে নিউল্যান্ডস কর্নারের একটি খাঁড়া ঢালে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেল সেটি। আশা ছিল গাড়ির ভেতর হয়তো আগাথাকে পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই আশায়ও গুড়েবালি, পাওয়া গেল না তাঁকে। এমনকি তাঁর কোনো চিহ্নই সেখানে পাওয়া গেল না যা দেখে মনে হবে তিনি কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
এদিকে দিনের পর দিন কেটে যায়, মানুষজনের মধ্যে চাঞ্চল্য আরো বাড়তে থাকে। ছড়াতে থাকে নানান গুজব ও ষড়যন্ত্রও। রহস্য উপন্যাস লিখতে লিখতে তাগলে আগাথা কি নিজেই রহস্য হয়ে গেলেন? এ যেন তাঁরই লেখা কোনো গল্পের প্লট!
গল্পের ডালপালা আরো মেলতে লাগলো, যখন জানা গেল যেখানে পরিত্যক্ত অবস্থায় তাঁর গাড়িটি পাওয়া গিয়েছিল, তার কিছু দূরেই রয়েছে সাইলেন্ট পুল নামের একটি প্রাকৃতিক ঝর্ণা। কিছুদিন আগেই সেখানে পাওয়া গিয়েছিল দুটি শিশুর লাশ। অনেকটা সুতোর জট ছাড়ানোর মতন মনে হলে আগাথা হয়তো ওই ঝর্ণার জলে ইচ্ছাকৃতভাবে ডুবে পড়ে গেছেন৷ কিন্তু তাঁর তো আত্মহত্যা করার মতন কোনো জোরালো প্রমাণও ছিল না৷ তাছাড়া তিনি তাঁর পেশাদার জীবনের এক সোনালী সময় পার করছিলেন৷ তাঁর ষষ্ঠ উপন্যাস ‘দ্য মার্ডার অব রজার অ্যাকরয়েড’ বইয়ের দোকানগুলোতে তখনো বেশ জমিয়ে ব্যবসা করছে। সাহিত্য দুনিয়ায় আগাথা ক্রিস্টি তখন একটি সুপরিচিত নাম।
আবার অনেকের মতে, আগাথা তাঁর পরবর্তী বইয়ের কাটতি বাড়ানোর জন্য আগে থেকেই গুম হয়ে যাওয়ার মতন সস্তা প্রচারণা শুরু করেছেন। আরেকদিকে মনে করা হচ্ছিল স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন আগাথা ক্রিস্টি। কারণ তার অসৎ চরিত্রের কথা আগাথা জেনে গিয়েছিলেন।
নিখোঁজ হওয়ার পুরো ১১ দিন পর, ১৪ই ডিসেম্বর অবশেষে খোঁজ মিলল আগাথা ক্রিস্টির। তাঁকে নিরাপদ অবস্থাতেই পাওয়া গেল হ্যারোগেটের এক হোটেলে। তাহলে তো রহস্যের সমাধান হয়েই গেল, তাই না? রহস্য তো এখানেই! গত ১১ দিন আগাথার সাথে যে কী কী ঘটেছে, তা তিনি কিছুতেই মনে করতে পারছিলেন না। যেন এই ১১ দিন তাঁর জীবন থেকে একেবারে হাওয়া হয়ে গেছে!
তাই রহস্যের সমাধান করার দায়ভার পড়লো পুলিশদের উপরে। তারা সব তথ্য একত্রে জড় করে যে সিদ্ধান্তে এলেন, তা হলো আগাথা মানসিক প্রশান্তির জন্য নিজ বাড়ি থেকে দূরে কোথাও যেতে চাচ্ছিলেন, মাঝপথে তিনি গাড়ি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন, এবং গাড়িসহ খাদের কিনারে পড়ে যান। সেখান থেকে উঠে এসে তিনি হ্যারোগেটের ট্রেন ধরে সেখানে যেয়ে সোয়ান হাইড্রো নামেত এক হোটেলে ওঠেন। তবে অদ্ভুত বিষয় হলো, হোটেলে ওঠার সময় তিনি আগাথা ক্রিস্টি না, থেরেসা নিল নামটি ব্যবহার করেছিলেন, যেটি কি না তার স্বামীর রক্ষিতার সম্ভাব্য নাম!
১৯২৬ সালের ৩ থেকে ১৪ ডিসেম্বর, এই ১১ দিন ঠিক কী হয়েছিল, সে ব্যাপারে একদম মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিলেন তিনি৷
কোনোরকম সহিংসতা ছাড়াই যেখানে তিনি তাঁর সব উপন্যাসের রহস্য সমাধান করে বেড়ান, যাঁর উপন্যাসের মূল টার্মই হলো, “হুডানিট”- তাঁরই জীবনে ঘটে যাওয়া এক রহস্যের সমাধান করতে পারলেন না কেউই!