এ যুগের আধুনিক লেখকদের মাঝে প্রশংসিত এবং বহুল উচ্চারিত নাম সুমন্ত আসলাম সহজ-সাবলীল রচনাশৈলী ও গল্প বলার ধরনের জন্য দ্রুতই পাঠকমনে জায়গা করে নিতে পেরেছেন। সেই স্থান ধরে রেখে প্রতি বছরই উপহার দিয়ে চলেছেন একের পর এক বই।
সুমন্ত আসলাম বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন সিরাজগঞ্জ জেলায়। তার বাবা মরহুম সোহরাব আলী তালুকদার এবং মা রওশনারা পারুল। পরিবারে আরো আছেন তার স্ত্রী ফারজানা উর্মী এবং কন্যা সুমর্মী।
পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক প্রভাবই মানুষের জীবন গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুমন্ত আসলামও তার পারিবারিক সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় বেড়ে উঠে নিজের সুপ্ত লেখক সত্ত্বাকে আবিষ্কার করেছেন। শৈশবেই তার ব্যাপক পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে। তার বড় ভাই প্রতি সপ্তাহে একটি করে নতুন বই কিনে আনতেন। এভাবে পারিবারিক লাইব্রেরিতে একে একে যোগ হয় অসংখ্য বই, বাড়তে থাকে তার পড়াশোনার পরিসর।
ভাই-বোনদের দেখাদেখিই বই পড়ায় মনোনিবেশ করেন ছোট্ট সুমন্ত আসলাম। তখন বাংলাদেশি কম, পশ্চিম বাংলার লেখকদের বই বেশি পড়তেন তিনি। যেমন- বিমল কর, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নীহার রঞ্জন রায় প্রমুখ বিখ্যাত লেখকদের বই পড়েই বড় হয়েছেন তিনি। বই পড়ার মাঝে তার এতটাই ভালোলাগা কাজ করতো যে, তিনি নিজের লেখক সত্ত্বাকে এই পড়ুয়া সত্ত্বা থেকে আলাদা করে ফেললেন, নিজেই হয়ে গেলেন একজন লেখক। লেখনীতে প্রথম থেকেই প্রতিফলিত হয় ভাষার উপর তার দক্ষতা। একজন একনিষ্ঠ সাহিত্য পাঠক হবার কারণেই সাহিত্য রচনায়ও আত্মবিশ্বাস সঞ্চার হয় তার। এভাবেই সুমন্ত আসলামের পদার্পণ ঘটে সাহিত্যাঙ্গনে।

সুমন্ত আসলামের মতে,
একজন ব্যক্তির লেখক হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত হলো একজন ভালো পাঠক হওয়া। লেখক হতে হলে অনেক পড়তে হবে, অনেক জানতে হবে, তবেই লেখার হাত পরিপক্ব হবে। তিনি বইপড়ুয়া ছিলেন বলেই আজ একজন জনপ্রিয় লেখক হতে পেরেছেন বলে মনে করেন।
পেশা হিসেবে সুমন্ত আসলাম বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। তিনি দৈনিক ‘প্রথম আলো’র রম্য ম্যাগাজিন ‘আলপিন’ এর বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক সমকাল এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন। এর পাশাপাশি লেখালেখিও চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতি বছরই সাহিত্যের একাধিক শাখায় তার ৫-৭টি বই প্রকাশিত হয়। বইমেলায় তার বইগুলোর রয়েছে আলাদা পাঠকশ্রেণী। বইয়ের স্টলে অনেক সময়ই দেখা মেলে তার। গুণমুগ্ধ পাঠকদের সাথে হাসিমুখে ছবি তুলতে কিংবা কারো বাড়িয়ে দেয়া নোটবুকে অটোগ্রাফ দিতে কখনো কার্পণ্য করেন না তিনি।
বইয়ের সাথে নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও লেখালেখির শুরু তার বেশ পরে, ঢাকায় আসার পর। ২০০১ সালে সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় তার প্রথম ছোটগল্পের বই ‘স্বপ্নবেড়ি’। গল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা, শিশু-কিশোর গল্প, রহস্য রচনাসহ তার বইয়ের সংখ্যা প্রায় দেড় শতাধিক।
‘হয়তো কেউ এসেছিল’, ‘নীল এই যে আমি’, ‘আমি আছি কাছাকাছি’, ‘কোন কোন রাত একলা এমন’, ‘তবুও তোমায় আমি’, ‘অযান্ত্রিক’, ‘ভালো থেকো ভালোবেসে’, ‘রাসকেলস’, ‘কেউ একজন আসবে বলে’, ‘তবুও তোমায় আমি’, ‘অনুভব’, ‘দহন’, ‘আই সি দ্য সান’, ‘আই এম গুড ডু’, ‘কঞ্জুস’, ‘অগ্নিমানুষ’, ‘যে তুমি খুব কাছের’- তার লেখা উপনাসসমগ্র। এছাড়াও ‘মিস্টার ৪২০’ শিরোনামে রম্য সাহিত্যও রচনা করেছেন তিনি।
‘দুষ্টুগুলোর আজ মন খারাপ’, ‘দুর্ধর্ষ পাঁচ গোয়েন্দা’, ‘দস্যি ছেলের দল’, ‘পাঁচজন দুষ্টু ছেলে’, ‘মহাদুষ্টু চারজন’, ‘স্কুল থেকে পালিয়ে’, ‘ডানপিটে ডাবলু’, ‘রাতুল দ্য গ্রেট’, ‘কিডন্যাপের কবলে পাঁচ গোয়েন্দা’, ‘ভালো ছেলেগুলোর দুর্দান্ত মিশন’ তার শিশু-কিশোর গ্রন্থ।
শিশুদের জন্য ভূত-প্রেত এবং রহস্যের মিশেলে রচিত বই ‘রাফাতের ভয়ংকর রাত’, ‘নাহিনের পোষা ভূতের বাচ্চা’, ‘ভূতবন্ধু’, ‘অদৃশ্য আতংক’ ইত্যাদি।

সুমন্ত আসলামের একটি অনবদ্য সৃষ্টি ‘বাউন্ডুলে’। ব্যাঙ্গ ও রম্য রচনা ভিত্তিক এই সিরিজের ১৬টি বই রয়েছে, যার প্রতিটিই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। ছোট ছোট ১৬টি বইয়ে পাঠক নির্মল আনন্দ খুঁজে পাবে, খুঁজে পাবে ভাবনার খোরাক। এই সিরিজে তিনি মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছেন তার সৃষ্টিশীল লেখনীর মাধ্যমে। তিনি মানুষের স্বাভাবিক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তনের বার্তা দিয়েছেন ঠাট্টা-বিদ্রুপের মাধ্যমে। খুব সহজ কথায় তিনি তুলে ধরেছেন জীর্ণ-শীর্ণ সমাজব্যবস্থা এবং মানুষের অবস্থানকে।
কাছের বন্ধুদের কাছে স্বপ্নবাজ হিসেবেই পরিচিত সুমন্ত আসলাম। তিনি দেশ এবং জাতিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। সমাজে প্রতিষ্ঠিত সমস্যাগুলো কোনো দিন দূর হবে, মানুষের জীবনে শান্তি নেমে আসবে- এটাই তার বিশ্বাস। তার স্বপ্ন ও বিশ্বাস তিনি তার রচনায় প্রকাশ করেন এবং পাঠকের মনেও গেঁথে দেন। এতে করে পাঠকবৃন্দ চমৎকার কিছু বার্তা পায় তার লেখার মাধ্যমে।
নিজের স্বপ্নগুলো কেবল লেখালেখির মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখেননি সুমন্ত আসলাম। সাধ্য অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করার সম্পূর্ণ চেষ্টাও করেন তিনি। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য তৈরী করেছেন ‘চাইল্ডড্রিম সোসাইটি’। সেখানে তিনি ছিন্নমূল ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শিখিয়ে তাদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষুদ্র প্রয়াস চালান। স্রোতের বিপরীতে স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাওয়া এই সাহসী যোদ্ধার জীবনযুদ্ধ যে একদিন সফল হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।