শুরু করা যাক, হুমায়ূন আহমেদের রবীন্দ্রনাথ পড়া শুরু করার কথা দিয়ে।
হুমায়ূন আহমেদের ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে-এক’ শিরোনামের লেখায় পাওয়া যাচ্ছে, ‘রবীন্দ্রনাথ আমার শৈশবের বিভীষিকার নাম। কারণটা বলি, বাবা ছেলেমেয়েদের রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত করার মহান দায়িত্ব হাতে নিলেন। আমাদের তিন ভাইবোনকে ডেকে হাতে সঞ্চয়িতা ধরিয়ে দিলেন- সবাইকে একটি করে কবিতা মুখস্ত করতে হবে। আমার ছোট বোন শেফুর ভাগে পড়ল ‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী’। জাফর ইকবাল পেল ‘প্রশ্ন’। আমার কপালে পড়ল ‘এবার ফেরাও মোরে’। একশ সাতাশ লাইনের বিশাল কবিতা। এই কবিতাটি বাবার বিএ ক্লাসে পাঠ্য ছিল। তিনি মুখস্ত বলতে পারেন। তিনি চাচ্ছেন তার বড় ছেলেও পারবে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এত বড় কবিতা কিছুতেই মুখস্ত হয় না। …’ (বসন্ত বিলাপ, প্রথমা, পৃষ্ঠা.৫৬)।
একই লেখায় উল্লেখ করছেন, ‘সত্যিকার অর্থে রবীন্দ্রনাথ প্রথম পড়ি আমি যখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র। থাকি বান্দরবান। বাবা সেখানকার পুলিশ লাইব্রেরির জন্য বই কিনেছেন। বইগুলোর একটি হল, সঞ্চয়িতা, আরেকটি হল গল্পগুচ্ছ। আমি গল্পগুচ্ছ কবজা করে ফেললাম। …। আমার পড়া রবীন্দ্রনাথের প্রথম গল্পের নাম ‘নিশীথে’। একটি ভূতের গল্প অথচ কোথাও ভূত নেই। আমি এখনো অবাক হয়ে ভাবি, ভূত ছাড়া ভূতের গল্প লেখার মত ক্ষমতা আর কতজনের আছে!’
প্রাসঙ্গিকঃ রবীন্দ্রনাথের যে ৫ টি তথ্য আবার নতুন করে জানতে পারেন
কেউ কেউ হয়তো মনে করতে পারবেন, হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘আমার ছোলেবেলা’য় একটু অন্যরকম লিখেছেন, ‘…ষষ্ঠ শ্রেণীর একটি বালকের সেই লেখা পড়ে আমার সাহিত্যিক বাবা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। শুধু মুগ্ধ না- প্রায় অভিভূত হবার মতো অবস্থা। জলপ্রপাত বিষয়ক রচনার কারণে উপহার পেলাম- রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। গল্পগুচ্ছের প্রথম যে গল্পটি পড়ি তার নাম ‘মেঘ ও রৌদ্র’। পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। তারপর চোখ মুছে আবার গোড়া থেকে পড়া শুরু করলাম। আমার নেশা ধরে গেল।’ (আমার ছেলেবেলা)।
তথ্যের অমিলটুকু ছিদ্রান্বেষীর জন্য তোলা থাক। আমাদের দরকার অন্য দুটো বিষয়।
এগার বারো বছর বয়সে হুমায়ূন আহমেদ রবীন্দ্রনাথ মন দিয়ে পড়া শুরু করেন এবং সেটা শুরু হল গল্প দিয়েই।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, দুই লেখাতেই হুমায়ূন তার ‘প্রথম’ পড়ার কথা বলতে চেয়েছেন, কোথাও ‘হয়ত’, ‘সম্ভবত’ বা ‘আমার মনে হয়’- এই রকম শব্দ বা বাক্য নেই। বরং আত্মবিশ্বাস নিয়ে, প্রেক্ষাপট তৈরি করে বিশ্বাস করিয়ে ফেলেছেন তিনি যা বলছেন তাই সত্যি।
এই ‘প্রথম’ শব্দটিতেই হুমায়ূনের নাটকীয় করবার প্রবণতা, বিশেষ করার প্রবণতা, লোককে একমুখী করে তার মুখী করবার ইচ্ছে গোপনে লুকিয়ে আছে। ‘প্রথম’ না বলে হুমায়ূন এই কথা কিছুতেই বলতে পারছেন না।
‘মেঘ ও রৌদ্র’। জীবনের এই আপাত বৈরিতা তাঁর রক্তে ঢুকে গেছে। হয়তো শৈশবের দিনগুলোতে পড়া রবীন্দ্রনাথই তাকে এই দ্বন্দ্ব শিখিয়েছেন। তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাসের নাম ‘নন্দিত নরকে’। নরক তবে নন্দিত। আনন্দিত দুঃখবাস। ‘আমার ছেলেবেলা’ গ্রন্থে শেষের পাতায় লেখা রয়েছে, ‘আমার শৈশবটা কেটেছে দুঃখ মেশানো আনন্দে আনন্দে’। জীবনের এই ‘দুঃখ আনন্দের’ ধারণা হুমায়ূন আহমেদ তীব্র ভাবে এঁকেছেন তাঁর অজস্র লেখায়, যেমনটা রয়েছে রবীন্দ্রনাথে।
.
প্রথম আমেরিকা বাসের নিঃসঙ্গতা বর্ণনায়ও রবীন্দ্রনাথও ভালো লাগছে না এই কথা হুমায়ূন আহমেদকে বলতে শোনা গেল-
“ আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত একা-একা নিজের ঘরে বসে রইলাম। কিছুই ভালো লাগে না সঙ্গে একটি মাত্র বাংলা বই- রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। ভেবেছিলাম একাকিত্বের জীবনে গল্পগুলো পড়তে ভালো লাগবে। আমার প্রিয় গল্পের একটি পড়তে চেষ্টা করলাম-
‘… সুরবালার সঙ্গে একত্রে পাঠশালায় গিয়াছি তবং বউ-বউ খেলিয়াছি। তাহাদের বাড়িতে গেলে সুরবালার মা আমাকে বড় যত্ন করিতেন এবং আমাদের দুইজনকে একত্র করিয়া আপনা-আপনি বলাবলি করিতেন,’আহা দুটিতে বেশ মানায়।’ …’ (গল্পের নাম ‘একরাত্রি’/ হুমায়ূন আহমেদ নাম উল্লেখ করেন নি।)
আমার এত প্রিয় গল্প অথচ পড়তে ভালো লাগলো না। (হোটেল গ্রেভার ইন, ১৯৮৯, কাকলী প্রকাশনী পৃষ্ঠা ১৫)।
দু কদম পেছনে ফেরা যাক।
হুমায়ূন আহমেদের বাবা মার বিয়ের কালের কথা। তাঁর নানা ঠিক করলেন যেহেতু ছেলে নাটক নভেল পড়ে সেহেতু মেয়েকেও প্রস্তুত থাকতে হবে। ‘মৈমনসিংহ’ গিয়ে কিনে আনলেন উপন্যাস, ‘নৌকাডুবি’। তাঁর মা’র জীবনে পড়া প্রথম উপন্যাস। প্রথমবার পড়ে মোহিত তাঁর মা, কয়েক বার পড়লেন উপন্যাসটি।
“বাসর রাতে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি কখনো বই টই পড়েছ? এই ধর, গল্প- উপন্যাস’।” তাঁর মা ক্ষীণ স্বরে বলেছিলেন, ‘নৌকাডুবি’।
হুমায়ূন আহমেদ লিখছেন, “গভীর বিস্ময়ে বাবা দীর্ঘ সময় কোন কথা বলতে পারলেন না। এই অজ পাড়াগাঁয়ের একটি মেয়ে কি-না রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ পড়ে ফেলেছে?…সেই রাতে বাবা-মা’র মধ্যে কি কথা হয়েছে আমি জানি না। জানার কথাও নয়। তারা আমাকে বলেনি। কিন্তু আমি কল্পনা করে নিতে পারি, কারণ আমি এবং আমার অন্য পাঁচ ভাইবোন তো তাদের সঙ্গেই ছিলাম। লুকিয়ে ছিলাম তাদের ভালোবাসায়।”
আরও পড়ুনঃ
বিশ্বসেরা ২০ জনঃ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব যাদের বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি
যুগান্তকারী ১০ জন নোবেল বিজয়ীর গল্পকথা
মিসির আলি – রহস্যময় কাল্পনিক চরিত্রটির খুঁটিনাটি !
হুমায়ূন আহমেদের সবগুলো বই দেখুন