বুয়েটে তখন কেবল ভর্তি হয়েছেন। একে তো বুয়েট, তার উপর সাবজেক্টটাও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং! কিন্তু বিপদ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হচ্ছে না। চারদিকে তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন। সে সময় রংপুরে এক নারীকে দেখে তাঁর ভীষণ ভালো লেগে যায়। বলা বাহুল্য, মুগ্ধ’ই হয়েছিলেন। সেই মুগ্ধতা থেকেই লিখে ফেললেন বিখ্যাত সেই কবিতা, ‘তুই কি আমার দুঃখ হবি?’
বিখ্যাত লেখক আনিসুল হকে’র পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যিক হয়ে ওঠার শুরুটা ঠিক তখন থেকেই।
একটু ছোটবেলা থেকে ঘুরে আসা যাক। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকে‘র শৈশব-কৈশোর কেটেছে রংপুরে। রংপুর জিলা স্কুল থেকে ১৯৮১ সালে এস. এস. সি. এবং রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ১৯৮৩ সালে এইচ. এস. সি. পাস করেন। উভয় পরীক্ষাতেই তিনি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছেন। পরীক্ষার ফল শুনে মনে হতেই পারে, লেখক বুঝি কেবল পড়াশুনা’ই করতেন। কিন্তু এমনটা ভাবলে সত্যিই বড় ধরণের ভুল করবেন। বরং ‘দুরন্ত’ শব্দটাও বিশেষণ হিসেবে কম হয়ে যায় তাঁর জন্য।
ছেলেবেলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি একবার বন্যার জলে নৌকা নিয়ে গেছি, সেই নৌকা ডুবে গিয়েছিল, আমি সাঁতরে উঠেছি। আরেকবার গরুর গাড়ি করে ধান আনতে গিয়ে ব্রিজের নিচে পড়ে গিয়েছিলাম, আমি সেই ধানের বস্তার নিচে চাপা পড়তে পারতাম। একবার তো গাছের মগডালে অনেক উঁচুতে উঠে আর নামতেই পারছিলাম না, কীভাবে যে বুকে বেয়ে বেয়ে নিঃসঙ্গ উঁচু একটা শাখা পার হয়েছি সেটা শুধু আমি জানি। সে কথা মনে করলে এখনও আমার ভয়ে শরীর শিউরে ওঠে যে আমি মারা যেতে পারতাম’।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না, ‘যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে’। চাইলে, লেখক আনিসুল হকে’র সঙ্গে প্রবাদটির মিল খুঁজতেই পারেন।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তাঁর মাথায় কবিতার নেশা চেপে বসলো। মেধাবী ছাত্রের যে তকমা এতদিন গায়ে জড়িয়ে ছিলেন, তা একটু একটু করে মলিন হতে লাগলো। তবে এজন্য কবিতা’ই একমাত্র কারণ ছিল না। বাবা’র মৃত্যুর পর সেই শোক কাটিয়ে লেখাপড়ায় আবার মন দেওয়াটা একটু কঠিনই ছিল তাঁর জন্য। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, বাকি জীবনটা লেখক হয়েই বাঁচবেন। বন্ধুদের কেউ কেউ তাঁর পড়ালেখা’র খোঁজ করলে নিঃসংকোচে বলতেন, ‘আমি সংবাদপত্রে কাজ নেব আর লেখালেখি করবো’।
ঠিক তাই করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই সাপ্তাহিক ‘পূর্বাভাস’ পত্রিকায় যোগ দিলেন।
১৯৮৯ সালে আনিসুল হকে’র প্রথম কবিতার বই -‘খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে’ প্রকাশিত হয়। সেই শুরু, এরপর বাকিটা সময় তিনি কেবল দু হাতে লিখে গিয়েছেন। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান, ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, শিশুসাহিত্য, নাটক; কী লেখেন নি? সাহিত্যের সবক্ষেত্রেই এই কথাসাহিত্যিকের অবাধ বিচরণ।
তবে এর মাঝে একবার সাংবাদিকতা বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মন দিয়েছিলেন তিনি। পরে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেলওয়ে বিভাগে যোগদান করেন। তবে চাকরি মনের মতো না হওয়ায় অল্প কিছুদিন পরই তা ছেড়ে দিয়ে আবারও পুরোদমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর তিনি সাপ্তাহিক দেশবন্ধু, খবরের কাগজ, ভোরের কাগজেসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছেন। বর্তমানে দেশের শীর্ষ জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’তে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন।

১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় আনিসুল হক রচিত প্রথম উপন্যাস ‘অন্ধকারের একশ বছর‘।
এরপর একে একে তিনি পাঠকদের বেশকিছু অসাধারণ উপন্যাস উপহার দিয়েছেন। ‘মা‘, ‘ফাঁদ‘, ‘ফাল্গুন রাতের আঁধারে‘, ‘ভালোবেসে তোমাকে দিলাম‘, ‘বিক্ষোভের দিনগুলির প্রেম‘, ‘ফিরে এসো, সুন্দরীতমা‘, ‘ভালবাসি, ভালোবাসি‘, ‘আমার একটা দুঃখ আছে‘, ‘নিধুয়া পাথার‘, ‘নন্দিনী‘, ‘সে‘, ‘ভালোবাসা আমি তোমার জন্য কাঁদছি‘, ‘আয়েশামঙ্গল‘, ‘প্রিয়তমা, তোমাকে‘, ‘তোর জন্যে, প্রিয়তা‘, ‘ক্ষুধা এবং ভালোবাসার গল্প‘, ‘হৃদিতা‘, ‘আমারও একটা প্রেমকাহিনি আছে‘, ‘সেঁজুতি, তোমার জন্য‘, ‘বেকারত্বের দিনগুলিতে প্রেম‘ ইত্যাদি ছাড়াও আরও অসংখ্য পাঠকপ্রিয় উপন্যাস তিনি লিখেছেন। তবে ২০০৩ সালে ‘সময় প্রকাশন’ প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘মা‘ উপন্যাসটির কথা বিশেষ করে বলতেই হচ্ছে। এটি’ই এখন পর্যন্ত আনিসুল হকের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস।
প্রায় তিন দশক ধরে একজন সফল সাহিত্যিক হিসেবে এদেশের সাহিত্য অঙ্গনে অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ আনিসুল হক ভূষিত হয়েছেন বিভিন্ন সাহিত্য বিষয়ক সম্মাননায়। এছাড়াও নাটক ও চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার সুবাদেও জিতেছেন নানা পুরস্কার। একজন কৃতী সাহিত্যিক হিসেবে লাভ করা আনিসুল হক-এর সাহিত্য পুরস্কারগুলো হলো:
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০১২)
- খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার
- শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে ‘সিটি ব্যাংক আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার’
- ইউরো শিশু সাহিত্য অ্যাওয়ার্ড (২০০৬)
- কবি মোজাম্মেল হক ফাউন্ডেশন পুরস্কার
- খুলনা রাইটার্স ক্লাব পদক
- পাঞ্জেরী ছোটকাকু আনন্দ আলো শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১৯) ইত্যাদি।
এছাড়াও চিত্রনাট্য লিখে তিনি অর্জন করেছেন শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে ‘বাচসাস অ্যাওয়ার্ড‘, ‘টেনাশিনাস পদক‘ ইত্যাদি।
লেখক হিসেবে তিনি কতটা সফল তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে একটা মজার ঘটনা দিয়ে শেষ করি। যার জন্য তাঁর কবিতা লেখা (তুই কি আমার দুঃখ হবি), সেই নারীর সঙ্গে ৫২ বছর বয়সে তাঁর ঠিকই দেখা হয়েছিল। সেই নারী’ই তাকে ফোন করে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। বলা বাহুল্য, একদিন যার জন্য কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন, তিনি কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের একজন বড় ভক্ত।
আনিসুল হকের সকল বই পড়তে
comments (0)