সেই সময় হাই স্কুল, কলেজ পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীদের স্মার্টফোন বা নীল-সাদা আলোর দুনিয়া হাতছানি দিত না। আশি-নব্বইয়ের দশকের গল্প বলছি, যে সময়ের শৈশব এখনকার যান্ত্রিকতা থেকে অনেক দূরে আর অনেক রঙীন ছিল। সে সময়ের রাত জাগার শিহরণ মানে স্যোশাল মিডিয়া না, ভিডিও গেম বা অনলাইন গেম না, মায়ের বকা উপেক্ষা করে রাত জেগে কখনো কম্বলের নিচে টর্চ জ্বেলে, কখনো ক্লাসে বসে পাঠ্যবইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে টান টান উত্তেজনা! কী হয় এরপর, কী হয়! হাতে হাতে তখন তাদের তিন গোয়েন্দা সিরিজ। যে সিরিজটি প্রথম আলো পত্রিকার জরিপে বাংলাদেশের কিশোরদের মধ্যে সর্বাধিক পাঠযোগ্য সিরিজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। একুশে বই মেলায় তখন এই তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা হাজারো অভিভাবকের ক্রোধের শিকার। এ কী নেশা ধরিয়েছেন বাচ্চাদের মনে তিনি! অন্যদিকে স্কুল-কলেজেও এমন কোনো বন্ধু মহলও কি খুঁজে পাওয়া যাবে সে সময়ে, যেখানে ‘তিন গোয়েন্দা‘ এর কোন চরিত্র কে তুলে ধরবে, কে হবে কিশোর, কে হবে মুসা, কে হবে রবিন- তা নিয়ে চুলোচুলি হয়নি ? হ্যাঁ, উন্মাদনা কিন্তু ততটাই ছিল।
সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘তিন গোয়েন্দা‘ নামক এই তুমুল জনপ্রিয় গোয়েন্দা কাহিনীর স্রষ্টা রকিব হাসান।
যেভাবে রকিব হাসানের বেড়ে ওঠা
রকিব হাসান এর জন্ম ১৯৫০ সালে , শৈশব কেটেছে কুমিল্লায়। তবে ‘কথা সাহিত্যিক রকিব হাসান‘ এর জন্ম ১৯৭৭ সালে। এর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন দুর্দান্ত পর্যায়ের পাঠক, যার একমাত্র নেশা বই পড়া।
ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রচন্ড পড়ুয়া। এমনকি সেই নেশা এমন পর্যায়ের ছিল যে ক্লাস থ্রি-ফোরে থাকাকালেই ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা‘ বইটি পড়ে শেষ করে ফেলেছিলেন, যা সেই বয়সে বোঝার পক্ষে দুঃসাধ্য ছিল। এক্ষেত্রে লেখক নিজেকে তাঁরই সৃষ্টি চরিত্র রবিন মিলফোর্ড এর সাথে তুলনা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, যে রবিনকে তার ভক্তরা বইপোকা ও চলন্ত জ্ঞানকোষ হিসেবেই চেনে। তাঁর আকর্ষণের জায়গা ছিল কিছুটা হালকা মেজাজের অ্যাডভেঞ্চার, শিকারের গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, কিংবা হাস্য-রসাত্মক লেখা। সেসময় তার পছন্দ মতো ভালো কিছু যা পেতেন, সেটা রাশিয়া থেকে আসা বাংলা অনুবাদ করা রাশিয়ান বই আর ভারতের দেব সাহিত্য কুটিরের প্রকাশিত সামান্য কিছু বই, যেগুলো তাদের পূজোর সময় বেরোত।
বাসার কাছের নির্জন দীঘির পাড়ে কিংবা পুরোনো পুকুরে ছিপ ফেলে প্রায়ই ছোট্ট লেখক ভাবতেন-
“আহা, আমাদের জন্য কেউ যদি একটা গোয়েন্দা কিংবা অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ লিখত! যেটা শুধুই কিশোরদের, যাতে শুধু আনন্দই থাকবে, বাস্তব জীবনের দুঃখ-কষ্ট থেকে বহু দূরে কোনো এক আনন্দ-ভুবন।”
ছোটবেলায় বইয়ের অভাবে ভুগতে ভুগতে নিজেই একদিন লিখতে বসে গেলেন। ক্লাস এইটে পড়েন তখন লেখক। একটা গোয়েন্দা কাহিনী লিখেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ‘ডাকু মনসুর’। লেখার পর তিনি দেখলেন ‘দস্যু বাহরাম’ এর দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। রকিব হাসান এর সেই দুরন্ত কৈশোরের বিস্তারিত গল্প খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর ‘আমার কৈশোর’ বইটিতে, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। ফেনী শহরে বড় হওয়া, বিকেলবেলা দীঘির পাড়ের দাদুর সাথে গল্প করা, বই পড়া, দুপুরের কড়া রোদে সাঁতার কাটা, বনের ভেতর বন্ধুদের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া, নিজের ফেলে আসা কৈশোরের সেসব রঙিন স্মৃতিগুলো এক সুতোয় গেঁথে রকিব হাসান তৈরি করেছেন তাঁর ‘আমার কৈশোর’।
কেমন ছিলো তার শিক্ষাজীবন?
রকিব হাসান এর শিক্ষাজীবন এর বেশিরভাগই কেটেছে ফেনী জেলায়। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণও সেখান থেকেই করেছেন। তারপর বিএসসি পাস করেছেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে। পেশাজীবী হিসেবে জীবন তাঁর শুরু হয়েছিল জুটমিলের চাকরি দিয়ে। লেখালেখিতে প্রবেশের গল্পটা আরও পরে শুরু হয়।

কথা সাহিত্যিক এবং অনুবাদক রকিব হাসান
বাংলা সাহিত্যে অনুবাদক রকিব হাসান এর প্রবেশ ১৯৭৭ সালে। পাঠক হিসেবে শুরুটা তাঁর বাংলা বই দিয়েই হয়েছিল। পড়তে পড়তে একসময় বাংলা বই এর খোরাক ফুরিয়ে আসতে থাকলো। কেননা পাঠক হিসেবে ভারি ধরনের লেখা তাঁর অপছন্দের ছিল। অ্যাডভেঞ্চার, শিকারের গল্প, গোয়েন্দা কাহিনীর নেশায় পড়তে পড়তে যার কারণে দ্রুতই একসময় বাংলা বইয়ের খোরাক ফুরিয়ে আসলো। ঝুঁকে পড়লেন ইংরেজি লেখার প্রতি।
সেসময় ইংরেজি সাহিত্য ডুবযাত্রায় তার সূচনা হলো জিম করবেটের হাত ধরে ‘ম্যান ইটারস অব কুমাওন‘ বইটির মাধ্যমে। সেই বইটি তখন তাকে এতটাই প্রভাবিত করল যে একসময় তার মনে হতে থাকল একাধারে সবরকম বাংলা বই পড়ার সিদ্ধান্তটি তাঁর ভুল ছিল। ইংরেজি সাহিত্যে রসদের যোগান এত বেশি খুঁজে পেলেন যে এতদিন বাছ বিচার ছাড়া বই পড়ে পার করে ফেলা সময়গুলোর জন্যেও তাঁর আফসোস হতে থাকল, কেন তিনি এ বিশাল জগতের সন্ধান আরো আগে পেলেন না!
তারপর হাতে তুলে নিলেন জেমস হেডলি চেজ এর থ্রিলার বই, যা তাকে আরও মুগ্ধ করল। মুগ্ধতা বাড়তে থাকল, বাড়তে থাকল ইংরেজি বই কেনা ও পড়ার সংখ্যা। এভাবেই নতুন বইয়ের সন্ধান করতে করতে পল্টনে এক বইয়ের দোকানে তাঁর আলাপ হয় গোয়েন্দা উপন্যাস লেখক ও অনুবাদক শেখ আব্দুল হাকিমের সাথে। সেসময় শেখ আব্দুল হাকিম সেবা প্রকাশনীতে লেখালেখি করতেন। তিনি ইংরেজী বইয়ের ছায়া অবলম্বনে অসংখ্য বই লিখেছিলেন, এবং সেসময় হঠাৎ নতুন প্লট খুঁজে পাওয়া নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন।
পাঠক হিসেবে তখন রকিব হাসান এর বিপুল সংখ্যক থ্রিলার ও অ্যাডভেঞ্চার বইয়ের সাথে জানা-শোনা, যা থেকে আসতে পারে নতুন বইয়ের প্লট। সেখান থেকেই ‘মাসুদ রানা‘র প্লট কেন্দ্র করে শেখ আব্দুল হাকিমের হাত ধরে সেবা প্রকাশনীতে রকিব হাসানের অনুপ্রবেশ। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ‘তিন গোয়েন্দা‘র লেখক হিসেবেই তাঁর পরিচিতি ঘটলেও লেখালেখির ক্যারিয়ারে তাঁর উদ্বোধন হয় ‘মাসুদ রানা‘র হাত ধরে। প্লট খুঁজতে সাহায্য করতে গিয়ে সেখানে নিজেই ‘মাসুদ রানা’র এক পর্ব লিখে ফেলেন যা পরবর্তীতে কাজী আনোয়ার হোসেনের মনে ধরে যায়। লেখাটি ছিল ‘মাসুদ রানা‘র ৫৫ তম পর্ব ‘কুউউ‘, যা রকিব হাসানের লেখা প্রথম বই এবং প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে ছদ্মনামে। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি, লেখক হিসেবে স্বতন্ত্র ক্যারিয়ারের পথে পা বাড়ান তিনি। ধীরে ধীরে সেবা প্রকাশনী থেকে একের পর এক বই ছাপা হতে হতে তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে অনুবাদ করা বইয়ের সংখ্যা। অনুবাদক রকিব হাসান এর ঝুলিতে রয়েছে কমপক্ষে ৩০টি বই।

লেখক হয়ে ওঠার গল্প
পেশাজীবী জীবন ছেড়ে রকিব হাসান পরবর্তীতে লেখালেখিতে এমনভাবেই জড়িয়ে পড়েন যে শুধুমাত্র একঘেয়ে জীবন থেকে বেরোতে নিয়মিত বসা শুরু করেন সেবা প্রকাশনীর অফিসে, ঠিক যেমন নিয়ম মেনে মানুষ রোজ অফিসে যায় লাঞ্চ বক্স সাথে করে। সেসময় সেবা প্রকাশনীর অফিস সেগুনবাগিচায় আর লেখক থাকতেন মিরপুর। যাতায়াত করতেন নিজের মোটরবাইকে। মিরপুর থেকে সেগুনবাগিচা অনেক দূর, তার ওপর রয়েছে রোদ-বৃষ্টি-শীত। তবু প্রথমে কিছুদিন ভালোই লাগল লেখকের। বলা চলে অফিস বিলাস। এমনকি বই লেখার সুবাদে আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে নিজেই নিজের জন্য একটা টাইপ রাইটারও কিনে ফেলেন। বাড়ি ও অফিসে দুটো আলাদা টাইপ রাইটার রাখা হলো তার। ঘরে ও অফিসে কাজ তার একটাই- লেখা আর লেখা!
পড়ার নেশাটাই ধীরে ধীরে লেখার নেশা ও পেশায় রূপ নিল। একসময় ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস‘ এর মতো গভীর ক্লাসিক বই অনুবাদের কাজে হাত দেন। নিতান্তই প্রাপ্তবয়স্কদের গভীর সেসকল লেখা লিখতে লিখতেই হঠাৎ তার হাতে আসে রবার্ট আর্থারের লেখা ‘দ্য স্টাটারিং প্যারট’, যা রবার্ট আর্থারের লেখা ‘থ্রী ইনভেস্টিগেটর্স‘ সিরিজের অংশ ছিল। লেখক তার ছোটবেলার কথা ভাবলেন। যেসময় তিনি বইয়ের জন্য পাগল হয়ে থাকতেন। সিনেমা ছাড়া বিনোদনের অন্য কোনো মাধ্যম ছিল না সেসময়, শুধু বইয়ের ওপরই নির্ভর করতে হতো। তা-ও খুব কম পেতেন। ছোটদের জন্য তখন বাংলায় বলতে গেলে প্রায় কিছুই লেখা হতো না, যা-ও হতো তার বেশিরভাগই রূপকথা কিংবা উপদেশে ঠাসা- পড়ে আনন্দ পাওয়া দূরে থাক, বিরক্তি ধরে যেত তাঁর। ‘থ্রী ইনভেস্টিগেটরস‘ সিরিজের ‘দ্য স্টাটারিং প্যারট’ লেখককে নতুন করে ভাবালো ছোটদের জন্য লেখার বিষয়ে, যার ছায়া অবলম্বনে পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে রকিব হাসান এর ‘তিন গোয়েন্দা‘ সিরিজের ‘কাকাতুয়া রহস্য’ বইটি।
সময়টা ছিল ১৯৮৫ সাল, সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে নিজেই ছুটে গিয়েছিলেন ছোটদের জন্য নতুন সিরিজ লেখার প্রস্তাব নিয়ে। প্লট শুনে কাজী আনোয়ার হোসেন বেশ আগ্রহ দেখালেন। যদিও সেটি ‘থ্রী ইনভেস্টিগেটরস‘ সিরিজের ৬ষ্ঠ বা ৭ম পর্ব ছিল। উৎসাহ পেয়ে রকিব হাসান ‘আরব্য রজনী‘কেও যেন দূরে সরিয়ে দিলেন। কাজে হাত দিলেন নতুন সিরিজের। সেই উদ্দেশ্য মাথায় রেখেই কোনো এক পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে খুঁজে বের করলেন ‘থ্রী ইনভেস্টিগেটরস‘ সিরিজের প্রথম পর্ব ‘দ্য সিক্রেট অব ট্যেরর ক্যাসেল’। সৃষ্টি হলো অমর তিন চরিত্র কিশোর পাশা, মুসা আমান ও রবিন মিলফোর্ড। লেখক তিনজনের মধ্যে বৈচিত্রপূর্ণ নানা গুণ ভাগ করে দিলেন। এর মাধ্যমে দাঁড় করালেন জোটবদ্ধ বিপুল ক্ষমতা। প্রথমজনের দিলেন ক্ষুরধার বুদ্ধি আর বিশ্লেষণী ক্ষমতা, দ্বিতীয়জনের গায়ের শক্তি, এবং তৃতীয়জনের বইপড়া জ্ঞান, যা গোয়েন্দাগিরিতে কাজে লাগবে। তিনজন কিশোরকে নিয়ে যেহেতু গল্প, তাই সিরিজের নাম হবে ‘তিন গোয়েন্দা‘।
রকিব হাসানের ‘তিন গোয়েন্দা‘ সিরিজের চরিত্রগুলোর সাথে রবার্ট আর্থারের লেখা ‘থ্রী ইনভেস্টিগেটরস‘ সিরিজের প্রধান তিন চরিত্রের স্বভাবে মিল থাকলেও শারীরিক গঠন ভিন্ন। কিশোর পাশার আন্তর্জাতিক সংস্করণের নাম জুপিটার জোন্স, রবিন মিলফোর্ডের আন্তর্জাতিক সংস্করনের নাম বব এন্ড্রু, এবং মুসা আমানের বেলায় সেটি পিটার ক্রেনশো। মূল ‘থ্রী ইনভেস্টিগেটরস’ সিরিজের ৪৩টি বই রয়েছে, যার প্রথম ১৩টি গল্প আর্থার জুনিয়রের লেখা। পরের ২৮টি গল্প লিখেছেন উইলিয়াম আর্ডেন ও মেরি ভার্জিনিয়া। এরপর ‘দ্য থ্রী ইনভেস্টিগেটরস ক্রাইম বাস্টার্স’ নামে নতুন সিরিজে আরও ১১টি গল্প আসে।

দিনে দিনে বাড়তে থাকল তিন গোয়েন্দার জনপ্রিয়তা ও চাহিদা। এত কম গল্পে তাই আর থেমে থাকা গেল না। রকিব হাসানের প্রবেশ করতে হল এনিড ব্লাইটনের ‘ফেমাস ফাইভ‘ সিরিজের কাহিনীতে। সেখান থেকে তিন গোয়েন্দায় নতুন সংযোজন হলো জর্জিনা পার্কার ও অস্বাভাবিক চোখা কানের মংগ্রেল কুকুর রাফিয়ান। দেখতে দেখতে ‘ফেমাস ফাইভ‘ এর ২১টি বইও শেষ হয়ে গেল। শুরু হলো এনিড ব্লাইটন এরই আরও একটি সিরিজ ‘সিক্রেট সেভেন‘। শেষে এসে রকিব হাসান তরী ভেড়ালেন ‘হার্ডি বয়েজ‘ এ। এই ছিল রকিব হাসানের ‘তিন গোয়েন্দা‘ সিরিজ এর ১৯ বছরের এক অবিস্মরণীয় ক্যারিয়ারের শুরু ও শেষ। আর এভাবেই রকিব হাসান নামটিও রবিন-কিশোর-মুসার সাথে জড়িয়ে গেল হাজার হাজার পাঠক-পাঠিকার কৈশোরের রোমাঞ্চকর কল্পনার জগতে।
লেখক হিসেবে তাঁর স্বাচ্ছন্দের জায়গা ফ্যান্টাসি ঘরানার লেখা। তাঁর ভাষ্যমতে, তিনি তাঁর সংগ্রামী জীবনের কষ্টের ছায়া তাঁর লেখায় ফেলতে চান না। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ার কারণে তাঁকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে জীবনে উঠে দাঁড়াতে। বইয়ের জগতটাকে তাই তিনি এই নির্মম বাস্তবতা থেকে দূরে রোমাঞ্চের মাঝে রাখতে চান। বাস্তব জীবনের ব্যস্ততা শেষে একটা বই যেন স্বস্তির জায়গা হয়ে ওঠে যা কঠিন বাস্তব থেকে অনেক দূরে।
কি ছিলো প্রথম প্রকাশিত বই!
রকিব হাসানের স্বনামে প্রকাশিত প্রথম বইটি ছিল ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা‘ বইটির অনুবাদ। পথচলা থেমে থাকেনি। অনুবাদ করেছেন এরিক জেরাল্ড ডুরেল, ফন দানিকেন, ফার্লে মোয়াটের মতো বিখ্যাত লেখকের অনেক বই। অনুবাদ করেছেন এডগার রাইস বারোজের ‘টারজান‘ সিরিজ। ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ‘তিন গোয়েন্দা‘র ১৫৮টি পর্ব প্রকাশিত হওয়ার পর কপিরাইট জনিত জটিলতার কারণে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর এই তিন চরিত্র নিয়ে তিনি লিখেছেন আরও দুটি সিরিজ ‘তিন বন্ধু’ ও ‘গোয়েন্দা কিশোর মুসা রবিন‘। সেগুলো পাঠক মহলে জনপ্রিয়তা পেলেও আগের সেই উন্মাদনা ছুঁতে পারেনি। অপরদিকে রকিব হাসান ‘তিন গোয়েন্দা’ লেখা ছেড়ে দেওয়ায় পাশাপাশি ভাল মানের কাহিনীর অভাব হওয়ায় সেবা প্রকাশনীর অনেক সিরিজের মতো ‘কিশোর হরর’ সিরিজের অনেক বই ‘তিন গোয়েন্দা’য় রূপান্তর করা হয় এবং ‘তিন গোয়েন্দা‘ ভলিউমে যোগ করা হয়।

পরে সেবা প্রকাশনা থেকে শামসুদ্দীন নওয়াব নামেও অনেক বই প্রকাশ পেয়েছে ‘তিন গোয়েন্দা‘ নামে। সিরিজের মধ্যে আরও লিখেছেন ‘কিশোর গোয়েন্দা’, ‘খুদে গোয়েন্দা’, ‘রোমহর্ষক’ (যা জাফর চৌধুরী ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছিল), এবং ‘গোয়েন্দা রাজু’ সিরিজ (যা আবু সাঈদ ছদ্মনামে প্রকাশ করেছিলেন)। গোয়েন্দা উপন্যাস ছাড়াও কিশোরদের জন্য বেশ কিছু ভূতের বই ও সাইন্স ফিকশনও লিখেছেন এই লেখক । নামে-বেনামে রকিব হাসান এর প্রকাশিত বই এর সংখ্যা প্রায় ৪০০। লেখক রকিব হাসান এর ঝুলিতে তিন গোয়েন্দারই ১৬০টি বই রয়েছে। ‘তিন গোয়েন্দা‘ আগের জায়গায় থাকুক বা না থাকুক পাঠক মহলে রকিব হাসান রচিত বই সমূহ এখনো সমাদৃত। ‘গোয়েন্দা কিশোর মুসা রবিন‘ সিরিজ এর মধ্যে তার জনপ্রিয় বই ‘রহস্যের দ্বীপ‘, ‘হাইপারসনিক রহস্য‘ , ‘গোল্ডেন বাইক রহস্য‘ , ‘অর্গান পাইপ রহস্য‘ , ‘অপারেশন বাহামা আইল্যান্ড‘ ,’বাঘের মুখোশ‘ , ‘উইন্ডি উডের রহস্য‘ , ‘আজব ভূত‘ , ‘তুষারগিরির রহস্য‘ , ‘মেরু ভাইরাস’ , ‘মেডেল রহস্য‘ , ‘বিষাক্ত ছোবল‘ , ‘স্মাগলার‘ , ‘নীল অর্কিড রহস্য‘ , ‘পাতাল শহর‘ , ‘সোনার মূর্তি‘ । কিশোর গোয়েন্দা কাহিনির মধ্যে রয়েছে ‘পর্বত অভিযান‘ , ‘ভূতের লকেট‘ , ‘ফ্লাইং সসার রহস্য‘ , ‘ডেথসিটির গোয়েন্দা‘ , ‘চোরের খোঁজে‘ , ‘কালো আংটির রহস্য‘ , ‘শয়তানের ঠিকানা‘ , ‘বারমুডা রহস্য‘ , ‘ড্রাগনের নিঃশ্বাস‘ , ‘ভূতের বাড়ি‘ , ‘জলাভূমির আতংক‘ , ‘খেপা দৈত্য‘ , ‘লাইটহাউসের ভূত‘ , ‘হান্টিং লজের রহস্য‘ , ‘ওয়াইল্ডক্যাট রহস্য‘। কমান্ডো সিরিজের মধ্যে রয়েছে ‘সোনার হরিণ‘ , ‘নরক যাত্রা‘ , ‘মরণনেশা‘। রোমাঞ্চপন্যাসের মধ্যে রয়েছে – ‘ঘাতক‘ , ‘মৃত্যুপরোয়ানা‘ , ‘মরনছোবল‘। এছাড়াও আরব্য রজনীর অনুবাদ বেশ কয়েক খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। সায়েন্স ফিকশান এর মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে – ‘মায়া সুরঙ্গ’ , ‘ছায়াপথে দূঃস্বপ্ন‘ , ‘মহাকাশের আতংক‘ , ‘মহাকাশের আতংক‘ , ‘ভিনগ্রহের দানব‘ , ‘অচেনা গ্রহের কিশোর‘।
রকিব হাসান রচিত প্রথম টেলিভিশন নাটক
রকিব হাসান রচিত প্রথম টেলিভিশন নাটক ছিল জনপ্রিয় কিশোর থ্রিলার ‘তিন গোয়েন্দা‘ অবলম্বনে। এর কাহিনীবিন্যাস ও নাট্যরূপ দিয়েছেন মাজহারুল হক পিন্টু, যা প্রচারিত হয়েছিল মাছরাঙা টেলিভিশনে। এছাড়াও চ্যানেল আই-এ ‘তিন গোয়েন্দা‘র উপর নির্মিত নাটক প্রচারিত হওয়া শুরু হলেও ১০ পর্বের পর তা বন্ধ হয়ে যায়।
দেখুনঃ রকিব হাসানের সকল বই
তথ্যসূত্রঃ
১) http://authors.com.bd/1161/About
২) https://www.youtube.com/watch?v=46jCA3Z314k
comments (0)