আমি ওনার ‘রাজনটী, আখ্যানটি শেষ করলাম। পড়তে বেশি সময় লাগেনি। আখ্যানটির পরিব্যাপ্তি সুদীর্ঘ; তবে ক্লান্ত হয়নি সহসা। খেই হারাইনি;বরং তাড়না ছিল শেষ করার। যেহেতু নিজে লেখালিখি করি তাই সব পুস্তক পরিতৃপ্তি দেয় না। স্বকৃত নোমান এর বইয়ের পাশাপাশি শেষ করলাম কহেলি জিবরানের ‘দি প্রফেট, অবিচ্ছেদ্য লাগেনি বরং একসাথে চলেছি। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে উপন্যাস সর্বাধুনিক এবং সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শাখা। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে প্রথম আধুনিক উপন্যাস রচিত হয়। সম্ভাবত ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাসের প্রবর্তন হয়। ইংরেজি ভাষায় ড্যানিয়েল ডিফো ও বাংলায ভাষায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস ধারার প্রথম সার্থক রূপকার।
স্বকৃত নোমানের আখ্যানটির
সময় আমার কাছে মনে হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে তবে রচিত হয়েছে একুশ শতকের একটু আগে ;সে জন্য এটি একটি স্বার্থক উপন্যাস। লেখক বিচক্ষণ এবং সাহসি লেখনির অধিকর্তা।
গল্পের নায়িকার নাম নুরজাহান তবে বাস্তবে;গল্পের স্থান কিংবা কালের পাঠক পড়লে হোচট খাবে,তাই আখ্যানে নায়িকার নাম গুলনাহারঃ এখানে লেখক বিদ্ধানের পরিচয় দিয়েছেন।
শওকত আলী যেমন প্রাকৃতজনের কথা বলেছেন;জহির রায়হান বলেছেন ‘হাজার বছর ধরে, উপন্যাসে অবহেলিত মানবের কথা, অদ্বৈত বলেছেন তিতাসের পাড়ের কথা; মানিক বলেছেন পদ্মার পাড়ের কথা, তেমনি স্বকৃত নোমান বলতে চেয়েছেন তেমনই কথা।
গুলনাহার রাজ দরবার হতে বিতাড়িত; সে আশ্রয় খুঁজছে। পথ চলতে চলতে রাত গভীর হলে সে একটা মন্দিরে আশ্রয় নেয়।তবুও তার ভয় যদি পুরোহিত তার সব কেড়ে নেয়; সে ভাবে তার কি আছে? চরিত্রের পবিত্রতা নোমান এখানে দেখিয়ে দিলেন; পাশাপাশি ধর্মের খেলাটাও।
বর্ণনা সাবলিলঃ মাঠ পেরোতেই দ্বিতীয় প্রহরে গড়াল রাত। দূরে চাঁদের আলোয় বালুচর চিকচিক করে,সুধাবতীর জল প্রবাহের মৃদু শব্দ শোনা যায়।অমর পুর কি তারও পুবে; পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে — —- এই নদী সমুদ্র কন্যা মেঘনায় মিশেছে।
কিছু কিছু জায়গায় লেখক গুলনাহারের কষ্টের গান গেয়েছেনঃ
“কাঁদিয় রজনী পোহায়
আঁখিজলে হৃদ ভেসে যায়
মনের আগুন তবু নিভে না যে তার।”
গুলনাহারের মা শিশু বয়সে অভাবের তাড়নায় তাকে বিক্রি করে দেয়। সে হতে কয়েক ধাপে হাত বদল হয়ে রাজদরবারে রাজনটী রূপে ঠিকানা হয়।তার রূপের বর্ণনা লেখক সামান্য দিয়েছেন এভাবে ঃ নাচাওয়ালির মোহময়ী চোখ,ক্ষীণ কটি,প্রমত্ত বুক।
একসময় সামান্য ভুলের কারনে রাজদরবার হতে বিতাড়িত হয়।অনেক পথ পাড়ি দিয়ে নিজের জন্ম ভিটায় যায়।
স্বকৃত নোমানের উপন্যাস রাজনটী দেখুন রকমারি ডট কম-এ
লেখক বলেছেন,“ শরীরে যৌবন আছে বটে,কিন্তু তা তো অতি ব্যবহারে জীর্ণ। বসত ভিটায় কেউ নেই; ভাবে ফিরে যাবে। আবার ভাবে গিয়ে কি করবে, কার কাছে গিয়ে বিক্রী করবে এই শরীর। গুলনাহার অনেক কষ্টে বাড়ীর উঠানে আসে; পরিত্যক্ত বাড়িটি কি কেউ দখল করল? আরো অনেক প্রশ্ন——
খুব কান্না পায় গুলনাহারের। মরা গাছের গুড়িতে বসে অনেকক্ষন কাঁদে। এভাবে আখ্যান আগাতে থাকে——–
জীবনের সকল পাপ হতে মোচনের জন্য গুলনাহার নিজ খরচে একটা মসজিদ নির্মাণ করে। মহল্লার লোক যখন জানতে পারে সে একজন রাজনটী তখন তাকে বিতাড়িত করা হয় গ্রাম হতে।
আখ্যানের শেষেঃ
গুলনাহারের খারাপ অবস্থার কথা লেখক বলেছেন,‘জোয়ার-ভাটায় সকাল-বিকাল যে নদীতে পাড় ধসে,ভয়াল বন্যাকে তার কী ভয়।,
নিজ জন্মভূমি হতে বিতাড়িত হয়ে গুলনাহার অজানায় পাড়ি দেয়, লেখকের বর্ণনা এ রকমঃ উত্তাল -স্রোতে ঝুরঝুর শব্দে ভেঙ্গে পড়বে সুধাবতীর বাঁধ। ভেঙ্গে ভেঙ্গে ভাঙ্গন হয়ত মসজিদ পর্যন্ত যাবে।মসজিদ হয়ত স্রোতে তোড়ে ভেসে যাবে।
গুলনাহার শাড়ির আচলে চোখ মুছে হাটতে শুরু করে। কোখায় যাবে সে?—
মনের আয়নার উঁকি দেয় পানামা শহর সে যে বহু দূরের পথ।
একজন রাজনটী বা নত্যকির জীবন নিয়ে আখ্যানটি রচিত। প্রথমত আমি একজন পাঠক হিসেবে বইটি শুধুই পড়িনি ;অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। বইটি পড়তে গিয়ে বার বার নোামানকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। একজন পাঠক যখন কোন লেখকের বই পড়ে পুলকিত হয়,শিহরিত হয় তখন সে লেখককে হৃদয় পটে স্থান দেয়। স্বকৃত নোমান আসলেই হৃদয় পটে স্থান পাওয়ার যোগ্য বটে।
দেখুনঃ স্বকৃত নোমানের সবগুলো বই