জেন অস্টেন উনিশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম সেরা বাস্তববাদী ঔপন্যাসিক। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর ছেলেবেলা গ্রাম্য পরিবেশে কাটলেও তিনি বেশ সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে বড় হয়েছিলেন। যার প্রতিচ্ছবি তাঁর উপন্যাসগুলোর মাঝে দেখা যায়৷
তবে গ্রামে থাকলেও তিনি আর তাঁর পরিবারের মহিলারা পার্শ্ববর্তী শহরে যেয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের বল নাচে অংশ নিতেন। এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যেয়েই পেয়ে যেতেন উপন্যাস লেখার নানা রসদ। এভাবেই প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রপ্ত করেছিলেন উপন্যাস লেখার কৌশল।
তাঁর উপন্যাসগুলো ১৯ শতকের গোড়ার দিকে লেখা, যখন বেশিরভাগ মহিলাদের জীবন কারো কন্যা, স্ত্রী এবং মা হিসাবে তাদের দায়বদ্ধতা নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয়কে ঢেকে দেয়। নারীকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিল্পকর্মের ভিত্তিতে পুরুষদের অধীন হিসাবে বিবেচনা করা হতো। এটি এমন একটা জীবন যা বহু মহিলাকে অবমাননা, একাকীত্ব এবং অপব্যবহারের মাধ্যমে আজীবন অন্যের নিন্দা শুনে যেতে হতো৷ কিন্তু তিনি কি নারীবাদী ছিলেন?

অনেকের মতে ছিলেন, আবার অনেকের মতে না। কারণ তাঁর ছয়টি উপন্যাসই প্রায় দু’শো বছর পুরোনো৷ সবগুলো উপন্যাসেই উঠে এসেছে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং সমালোচনা। অস্টেনের উপন্যাসগুলো তাঁর সময়ের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর কঠোরভাবে সমালোচনা করে।
আবার অনেক সাহিত্যবোদ্ধাদের মতে জেন অস্টিনের উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো ঠিক আজকের নারীবাদের মতাদর্শের সাথে খাপ খায় না। তবে নারীবাদ একটি গতিশীল তত্ত্ব, যা বহু শতাব্দী ধরে অস্তিত্বশীল এবং সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে।
কিন্তু জেন নারীবাদী ছিলেন কি ছিলেন না, তা জানার আগে জানতে হবে সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সম্পর্কে।
সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সিনড্রোম:
রূপকথার সিনড্রেলা তো আমরা প্রায় সবাই কম-বেশি চিনি। যারা এই কমপ্লেক্সে ভোগে তাদের মনে হয় একদিন তারা তাদের স্বপ্নের রাজকুমারকে খুঁজে পাবো এবং সেই রাজকুমারই তার সবকিছুর ভার গ্রহণ করবে। এবং তারা সারাজীবনই সব ভুলে সেই রাজকুমারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সিন্ড্রোম, একটি আবেগতাড়িত মানসিক রোগ, যা সাধারণত নারীদের হয়ে থাকে। অনেক মেয়েরাই মনে করেন যে তাদের দ্বারা স্বাধীন হওয়া বা স্বাধীনভাবে বাস করা সম্ভব নয়। তাদের মানসিক, আর্থিক ও শারীরিক যত্নের জন্য এমন কাউকে দরকার, যে কিনা সিনড্রেলা গল্পের রাজপুত্রের মত এসে তাদের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবে।
তারা নিজে চেষ্টা না করে, নিজেকে অন্যের মুখাপেক্ষী করে তুলে। নির্ভর্রশীল হয়ে পরে কোন নির্দিষ্ট একটি মানুষ বা কল্পনার রাজপুত্রের উপর। এটাই সিনড্রেলা কমপ্লেক্স। সিনড্রেলা কমপ্লেক্স সিনড্রোমের ভুক্তভোগীদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে নিজের উপর আত্ম-বিশ্বাসের ঘাটতি।
জেনের উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলোকে আংশিক হলেও এই কমপ্লেক্সে ভুগতে দেখা যায়৷ আমরা তাঁর ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস‘, ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি‘, ‘এমা’ সহ বাকি তিনটা উপন্যাসেও এমন নারী চরিত্র দেখতে পাই৷ সেখানে দেখা যায় ওই সমাজে একটা বড়লোক ছেলের সাথে বিয়ে করাটা কতটা সামাজিক মর্যাদাপূর্ণ।
সমাধিকার নিয়ে সোচ্চার:
জেন তাঁর উপন্যাসে যেই সময়ের কথা বর্ণনা করেছেন, সেই সময়ের নারীরা বিয়ের জন্য সবসময় ভালো পাত্রের সন্ধানে থাকতেন এবং বেশির ভাগ সময়ে তাদের পুরুষ আত্মীয়দের উপর নির্ভর করে চলতেন। তাঁর নারী চরিত্রগুলো দিয়ে দেখানো হয় যে সে সময়ের নারীদেরকে দ্রুত বিয়ে করার জন্য বাধ্য করা হতো এবং তাদের জীবন তাদের বাড়ির আঙিনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল।
১৯ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজ মহিলাদের উপন্যাস লেখার কথা কেউ মাথায়েই আনতে পারতেন না, এবং কেউ যদি কিছু একটা লিখেও ফেলতেন তাহলে সেটা প্রকাশ করা হতো না। তৎকালীন মহিলা উপন্যাসিকদের “লোভী ও নির্বিচার” হিসাবে বিবেচনা করা হতো, অনেকের বই প্রকাশ পায়নি শুধুমাত্র তারা নারী বলে। এই কারণে অনেক নারী পুরুষের ছদ্মনামে নিজের বই বের করতেন। জেনের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘সেনস অ্যান্ড সেনসিটিবিলিটি’ তাঁর নিজের নামে নয়, কেবল ‘এ লেডি’ ছদ্মনামে বের হয়েছিল।

যদিও তিনি ইংল্যান্ডের প্রথম মহিলা উপন্যাসিক নন- মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্টের “আ ভিন্ডিকেশন অব দ্যা রাইটস অব ওম্যান” অস্টেনের প্রথম উপন্যাসের ২০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল- কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বেশিসংখ্যক নারীদের লেখার দরজা খুলে দিয়েছিল।
তিনি কেবল উপন্যাস রচনা ও প্রকাশের মাধ্যমে এই রীতিবিরোধী হননি, বরং তাঁর গল্পগুলোয় ছিল দৃঢ়চেতা, প্রফুল্ল এবং নারী চরিত্র। তাঁর চরিত্রগুলো নিজেদেরকে যেই পরিস্থিতিতে পেয়েছিল, যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল যাতে সেখান থেকে তারা নিজের সুখ এবং তাদের নির্বাচনের অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারে।
জেন অস্টিনের উপন্যাসগুলো একদম সহিংসতাবর্জিত, তবে এখানে ১৯ শতকের গোড়ার দিকের ইংল্যান্ড সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আর তার সাথে সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর রীতিনীতি, আদব-কায়দা, নৈতিকতাবোধ এবং নানান চল-চাতুরীর মাধ্যমে কন্যাদের উচ্চবংশে পাত্রস্থ করা নিয়ে মায়েদের উদ্বেগের চিত্র উঠে আসে।
‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস‘ উপন্যাসে শার্লট বিয়ে করতে চেয়েছিল সামাজিক মর্যাদা, নিরাপত্তা আর নিজস্ব একটা বাড়ির জন্য। জেন এই কারণে মেয়েদের বিয়ে করাকে ঘৃণা করতেন। তিনি চাইতেন মেয়েরা যাতে আত্মমর্যাদাবান হোক, স্বাবলম্বী হোক।

জেন ও তাঁর বড় বোন ক্যাসান্ড্রা কখনোই বিয়ে করেননি। এর পেছনে দুটো কারণ রয়েছে। ক্যাসান্ড্রার বাগদত্তা বিয়ের আগেই জলে ডুবে মারা যান আর জেনের সাথে যার বাগদান সম্পন্ন হয়, সে পরদিনই বিয়ে ভেঙে চলে যান। এরপর দু’বোন একা এবং স্বাধীনভাবে থাকতে শুরু করেন, যা ওই সমাজের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি।
লেখক লয়েড ডব্লুউ ব্রাউনের মতে, বিংশ শতাব্দীতে যে নারীবাদী ঘরানার উত্থান ঘটেছিল, তার সূত্রপাত ঘটে অষ্টাদশ শতকে লেখা জেনের সাহিত্যে। তাঁর উপন্যাসগুলো থেকেই এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
আর এ প্রসঙ্গে জেনের পক্ষে প্রমাণ হিসাবে সমালোচকরা উপস্থাপন করছেন জেনের উপন্যাসের চরিত্র কিংবা উপন্যাসের উপজীব্যকে। তাঁর দু’টি জনপ্রিয় উপন্যাস ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ আর ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’-তে এসব বিষয়গুলো লেখক দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস‘ এর এলিজাবেথ বেনেটের কথাই ধরা যাক। অসম্ভব যুক্তিবাদী, নিজের অধিকার নিয়ে সচেতন এবং স্বাধীনচেতা। উচ্চাভিলাষী জীবন কিংবা অর্থ লোভ- কোনো কিছুই তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি। অপমান তো গায়ে মাখেই না, বরং যে অপমান করছে তাকেই সেই অপমান ফিরিয়ে দেয়৷ আর্থিক নিরাপত্তার জন্য একদমই বিয়ে করতে রাজি নয় সে। এমনই দৃঢ়চেতা অনেক নারী চরিত্র জেনের উপন্যাসগুলোয় আছে।
অনেকে জেন অস্টেনকে সরাসরি নারীবাদীদের কাতারে ফেলতে নারাজ, কারণ তিনি কখনওই অধিকার আদায়ের জন্য সহিংস আন্দোলনে অংশ নেননি। তিনি বলেছিলেন যে নারীদের উচিত পুরুষদের সমান অধিকার ও সুযোগ পাওয়া। বলা যায়, নারীবাদের বীজটি সাহিত্যে রোপণ করার প্রধান কৃতিত্ব তাঁরই।